
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে চারটি মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তিনটিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এই চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে আশা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কার্যালয়।
চারটি মামলার একটি হলো মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূল করা। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক।
আমলে নেওয়া অন্য তিনটি মামলা হলো রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা ও আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলা।
চার মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামি ৫৭ জন। তাদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ১৬ জন। সেই ১৬ জনসহ পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চলতি বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে ভুক্তভোগী এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর এখন পর্যন্ত মোট অভিযোগ এসেছে ৪৬৩টি। এর মধ্যে ৩০টি মামলায় ২০৯ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ৮৪ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত আর বাকিরা পলাতক।
মামলা ও বিচারের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের শহীদদের পরিবার, শহীদদের স্বজন, ভিকটিমদের আবেগ যেমন অ্যাড্রেস করতে হয়, তাদের বিচারের যে দাবি, যে তৃষ্ণা, সেটা যেমন অ্যাড্রেস করতে হয়, একইভাবে আইন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড, আসামির অধিকার এগুলোকেও মেইনটেন করেই এটা করতে হয়। সেটা করতে যে যুক্তিসঙ্গত সময় দরকার, সেটা আমরা নিয়েছি, সেটা আমরা নিচ্ছি।’
তাজুল ইসলাম বলেন, মোবাইল কোর্টের যেটা করা সম্ভব, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের পক্ষে সেই ধরনের বিচার সম্ভব নয়। এটার নির্দিষ্ট প্রসিডিউর আছে। সেই প্রসিডিউর ফলো করতে হয়। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। নভেম্বর পর্যন্ত কোর্ট সবকিছু ঠিকঠাক হতে সময় লেগেছে। তারপরে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে, ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রথম তদন্ত রিপোর্ট তদন্ত সংস্থা দিতে পেরেছেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এ মুহূর্তে চারটা মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। অনেকেই বলছেন, বিচার দৃশ্যমান দেখি না। বিচার দৃশ্যমান। চারটা মামলার ওপেন বিচার চলছে। আমরা লাইভ সম্প্রচার করেছি কিছু কিছু অংশ। ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায়। এ মামলা প্রমাণ করতে গিয়ে শহীদদের যে ভিডিও দেখেছি, তাদের প্রচণ্ড একটা দাবি আছে। সেটা হলো পারলে এখনই ফাঁসি দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা যখন বিচার করতে যাব আমাদের আবেগটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশের বাইরে বিশ্বব্যাপী একটা অডিয়েন্স আছে, যারা স্ক্যানার দিয়ে প্রতি মিনিটে স্ক্যান করে যে আমাদের বিচারটা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না।’
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে আসা খুন ও গুমের অভিযোগে করা মামলা ও তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউশন টিমের অন্যতম সদস্য গাজী মনোয়ার হোসাইন (এমএইচ) তামিম জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো সময়ের তুলনায় গত এক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গিয়েছিল ১৮ মাসে। আর গড়ে তদন্ত প্রতিবেদনের সময় ছিল আড়াই বছর থেকে তিন বছর। সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর প্রথম ছয় মাসে পাঁচটি তদন্ত প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন শেষ পর্যায়ে।
গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে কোনো একটি ঘটনার তদন্ত করলে এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ না। সারাদেশে প্রত্যেকটি ঘটনার একটি চিত্র তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) তার প্রতিবেদনে তুলে আনেন। সেই চিত্র বা সেই অপরাধেরই একটি অংশ কোনো একটি ঘটনার জন্য তদন্ত করে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পেশ করা হয়। যখনই দেখা যায় ওই ঘটনাটি সিস্টেমেটিক অন্যান্য ঘটনারই একটি অংশ তা হলেই কেবল এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। যে কারণে এই তদন্তটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। যদি শুধু একটি ঘটনার তদন্ত করা হয় তা হলে সেটি সাধারণ আইনে বিচার। তারপর প্রত্যেকটি মামলায় একটি পটভূমি তৈরি করি, ওই পটভূমিতে এ মামলার ঘটনার বাইরে আর কোথায় কী কী ঘটনা ঘটেছে সব বর্ণনা দিতে হয়।’
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
জটিল মামলা তদন্তে সন্তুষ্ট প্রসিকিউশন
এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে যেটা হয়েছে সেটা হলো সাধারণ মার্ডার থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ। একজন মানুষ খুন করে, সেটা অনুসন্ধান করে। আর এখানে দেড় হাজার লোক খুন হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হয়নি। ফ্যামিলি মেম্বারদের খবর দেওয়ার সুযোগ তারা দেয়নি। বলেছে, কেউ যদি নিয়ে যাওয়ার মতো থাকে নিয়ে যাক। অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ হিসেবে দাফন করে ফেলতে হবে। সেখানে শহীদের সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের রাতে মানুষের অজান্তে কবর দিতে হয়েছে। তাই এসব মামলার তদন্ত অত্যন্ত জটিল।
অন্য প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, পটভূমি ও ইতিহাস বিষয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা লাগে। মামলায় প্রমাণের জন্য সাধারণ সাক্ষী তো লাগেই। যার কারণে এই মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। সেই তুলনায় আমাদের তদন্ত সংস্থা অতি অল্প সময়ে যুক্তিসঙ্গত সময়েই তাদের তদন্ত সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ বিষয়ে আমরা মনে করি তদন্ত সংস্থা সন্তোষজনক কাজ করেছে।
প্রথমে না, পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা
গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘মামলার তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে আমরা কিছু জটিলতার সম্মুখীন হয়েছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। তাই দিনের পর দিন একটার পর একটা দাবিতে রাস্তা অবরোধ ও মানববন্ধন করা হতো। মাসের পর মাস এরকম আন্দোলন চলায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তার মধ্যে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই মামলা ও অভিযোগ নিয়ে। সে কারণে প্রথমদিকে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসহযোগিতা বা কম সহযোগিতা পেয়েছি। পরে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপে এসব অসহযোগিতা রিমুভ হয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ সহায়তা পাচ্ছি।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত মোট ৩০টি বিবিধ মামলা প্রি-ট্রায়াল স্টেজে আছে। এই ৩০টি মামলায় ২০৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়ে ৮৪ জন কারাগারে।
শিগগির আরও ১০টি মামলার তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে তদন্ত সংস্থা থেকে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মামলা রয়েছে। এসব মামলার তদন্ত শেষ করার পর শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন গাজী এমএইচ তামিম।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় ‘রাজসাক্ষী’ সাবেক আইজিপি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ওই মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেন যে আসামি; সাধারণত তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হিসেবেও ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন গত ১০ জুলাই।
অভিযোগ গঠনের শুনানিতে আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘আই প্লিড গিল্টি। আই অ্যাম উইলিং টু ভলান্টারিলি ডিসক্লোজ ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার অব দ্য হোল অব দ্য সারকামস্ট্যান্সেস উইদিন মাই নলেজ রিলেটিং টু দ্য ইনস্ট্যান্স কেস।’ অর্থাৎ, ‘আমি দোষ স্বীকার করছি। আমি স্বেচ্ছায় আমার জানামতে এ মামলা–সম্পর্কিত ঘটনার সত্য ও পরিপূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক।’
সাবেক আইজিপির এমন বক্তব্যের পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
অভিযোগ গঠনের পর এই মামলায় ‘ওপেনিং স্টেটমেন্ট’ বা সূচনা বক্তব্যের জন্য ৩ আগস্ট (রোববার) দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিন ট্রাইব্যুনালে মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে খোকন চন্দ্র বর্মণের (২৩) সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেন আদালত।
৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে গুলি করে ছয়জনকে হত্যা
গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুলে গুলি করে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১৪ জুলাই আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আসামিরা হলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। এসব আসামির মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক। অন্য চারজন গ্রেফতার। মামলার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ১০ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
আবু সাঈদকে হত্যা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৬ আগস্ট অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদসহ ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ আসামি পলাতক।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানো
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর মামলায় বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) অভিযোগ গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে আসামিপক্ষের শুনানির জন্য আগামী ১৩ আগস্ট দিন ঠিক করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
লাশ পোড়ানো হিসেবে পরিচিত এ মামলায় মোট ১৬ জন আসামির মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১১ জনের নাম প্রকাশ করেছে প্রসিকিউশন। এই ১১ জনের মধ্যে আটজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। বাকিরা পলাতক।
এর আগে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ আসামি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হকসহ ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৫ অক্টোবর দিন ঠিক করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১ এই দিন ঠিক করেন।
লক্ষ্মীপুরে পাঁচ হত্যায় তিন আসামি গ্রেফতার
গণঅভ্যুত্থানে লক্ষ্মীপুরে শিক্ষার্থীসহ পাঁচ হত্যার অভিযোগে অন্য মামলায় গ্রেফতার তিন আসামিকে গত ২৮ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে কারাগারে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আসামিরা হলেন—লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী, সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন জাবেদ ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন আলম। সঙ্গে মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করা হয়েছে।
যেসব মামলা প্রতিবেদনের জন্য রয়েছে
গণঅভ্যুত্থানের সময় সাভারে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান (এপিসি) থেকে টেনে নিচে ফেলে দেওয়া শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ১২ আগস্ট ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৬ সালে ঢাকার কল্যাণপুরে ‘জাহাজ বাড়ি’তে জঙ্গি নাম দিয়ে ইসলামিক ভাবধারার ৯ তরুণকে হত্যা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৪ সেপ্টেম্বর ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি হত্যার পর তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে হওয়া মামলার নথিপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে দেওয়ার আদেশও দেওয়া হয়েছে।
এই মামলায় পুলিশের সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং ডিএমপি মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) মো. জসীম উদ্দীন মোল্লাকে আসামি করা হয়েছে। তারা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। এছাড়া গণঅভ্যুত্থানের সময় নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিন আগামী ১২ অক্টোবর ঠিক করেন।
প্রসিকিউশন জানিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের সময় নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ৪০ জনকে হত্যার একটি মামলায় আট আসামির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেন অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে এখনো কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ঠিক করেন ১৪ সেপ্টেম্বর।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
গ্রেফতার হয়ে কারাগারে
গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, আমির হোসেন আমু, মো. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, ডা. দীপু মনি ও গোলাম দস্তগীর গাজী; সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
ট্রাইব্যুনালে হাজির করা আসামিদের মধ্যে আরও আছেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি-উত্তর) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
আব্দুর রহমান বদিও কারাগারে
সাত বছর আগে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৩ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানিতে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, একরামুল ফোনে কথা বলা অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলা, শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের বিচার
গুমের ১০০ অভিযোগ মায়ের ডাকের
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১০০টি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছে জোরপূর্বক গুমের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। ১০০ জনকে গুমের ঘটনায় এ অভিযোগগুলো করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯৫ জন এখনো ফিরে আসেননি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে অভিযোগ জমা দেয় মায়ের ডাক। পরে সংগঠনটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এসব অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাবেক ৬০ জন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।বিজ্ঞপ্তিতে মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম বলেন, মায়ের ডাকের নেতারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দেওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাজুল ইসলাম তাদের বলেন, অপরাধী যত শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।