
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে কমিশনের সুপারিশ করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদের নাম পরিবর্তনে সংশ্লিষ্টদের আপত্তি থাকায় খুব শিগগিরই এটি হচ্ছে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের ১৮টি সুপারিশের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে আপাতত ৮টিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে ডিসি ও ইউএনও পদের নাম পরিবর্তনের সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা নেই।
সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৮টি অপেক্ষাকৃত সহজে বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করছেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ জন্য ওই ৮ সুপারিশ কম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যে ৮টি সুপারিশকে গুরুত্ব দিয়ে আপাতত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো হচ্ছে—মহাসড়কের পেট্রল পাম্পগুলোয় স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটকে ডায়নামিক করা, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা, গণশুনানি, তথ্য অধিকার আইন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পুনর্গঠন এবং ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ছয়টি কমিশন গঠন করে। সেসবের একটি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সাবেক সচিব মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া কমিশনের সেই প্রতিবেদনের অধ্যায় ৬-এর ১১ অনুচ্ছেদে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদবি পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) নামে একটি নতুন সার্ভিসও গঠন করার সুপারিশ রয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। যার অধীনে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে জনপ্রশাসনের কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা, দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, জনগণের সেবাপ্রাপ্তি সহজ করা, স্থানীয় সরকারগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং প্রশাসনে দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পদের পদবি পরিবর্তন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ডিসি’র নতুন পদবি হবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা কমিশনার (ডিসি) এবং ইউএনও’র নতুন পদবি হবে উপজেলা কমিশনার। এছাড়াও, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)-এর পদবি পরিবর্তন করে অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পদের পদবি পরিবর্তনের বিষয়টি অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তবে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টিকে তাদের জন্য বিব্রতকর বলে মনে করছেন। তারা মনে করেন, পদবি পরিবর্তন করে জনসেবা নিশ্চিত করা যায় না। পদবি কোনও বিষয় নয় বলে মনে করেন তারা।
একাধিক কর্মকর্তার মতে, বিদ্যমান পদবিতে জনসেবা দিতে তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না। যারা সরকারের সেবা নিতে ডিসি অফিস বা ইউএনও অফিসে আসেন তাদেরও সেবা নিতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে কেন এই পদবি পরিবর্তন? দীর্ঘদিন চলে আসা এই পদবি পরিবর্তনের ইস্যুটি এখন তাদের জন্য বিব্রবতকর বলেও জানিয়েছেন তারা। কারণ ডিসি ও ইউএনও পদে নতুন যে পদবি সুপারিশ করা হয়েছে সে পদে কর্মকর্তাকে কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এই সময়ে জনগণকে দেওয়া নাগরিক সুবিধা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে বলেও মনে করেন তারা।
বিষয়টিকে যারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন তাদের মতে, ‘জেলা প্রশাসক’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়— যিনি এ পদে কাজ করেন তিনি সেই জেলার প্রশাসক। অর্থাৎ, তিনি সেই জেলার শাসনকর্তা। আগে এ পদটিকে বলা হতো ‘ডেপুটি কালেক্টর বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’। আর এ ডেপুটি কালেক্টর বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদের অধিকারকে ‘ডেপুটি কমিশনার’ পদের দায়িত্বও প্রদান করা হয়েছে। এ ডেপুটি কালেক্টর বা ম্যাজিস্ট্রেটকে বাংলা করতে গিয়ে করা হয়েছে ‘জেলা প্রশাসক’। এ ‘প্রশাসক’ শব্দটির ভেতরে ‘শাসক’-এর গন্ধ পাওয়া যায়! জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব আমলা জেলার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে এমন কিছু অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেন, যা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা ২০১৯ সালে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যাকাণ্ড মামলার শুনানির সময়ে আদালতের ভাষ্য তুলে ধরেন। তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন, যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। এমন ভাব দেখান, তারাই সব।’ জেলা প্রশাসককে সাধারণত ডিসি বলা হয়। এখন বুঝতে হবে ডিসি মানে কী? ডিসি মানে হলো ডেপুটি কমিশনার। এখন প্রশ্ন আসবে, উনি কার ডেপুটি? সাধারণত যাকে বিভাগীয় কমিশনার বলা হয়, ডেপুটি কমিশনার হলেন তারই ডেপুটি। অথচ যার বাংলা করতে গিয়ে ‘জেলা প্রশাসক’ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একাধিক ডিসি ও ইউএনও’র সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা পরিচয় প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম-পরিচয় গোপন রেখে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক বিভাগের একাধিক জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং একাধিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
বরিশাল বিভাগের দুজন ডিসি ও একজন ইউএনও বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, দেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এসে এ ধরনের একটি প্রস্তাব নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর। ডিসি পদে থেকে বা ইউএনও পদে থেকে নাগরিক সেবা না দেওয়া বা সেবা ব্যাহত হওয়ার সুযোগ নেই।
একইভাবে রাজশাহী বিভাগের একজন ডিসি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, দেশের প্রতিটি নাগরিক একজন জেলা প্রশাসক সম্পর্কে অবগত। তার দায়িত্ব সম্পর্কেও অবগত। নাগরিকরা তাদের নিজ জেলার ডিসিকে নিজেদের যেকোনও সমস্যা সমাধানে ভরসাস্থল বলে মনে করে। আমরাও তা মাথায় রেখে দায়িত্ব পালন করি। সরকারের প্রতিনিধি মনে করে এ কারণেই দেশের নাগরিকরা তাদের অভিযোগ ও দাবি-দাওয়া ডিসির কাছে উপস্থাপন করেন। জেলায় আর কোনও কর্মকর্তা নাগরিকদের অভাব-অভিযোগ ও দাবি-দাওয়া ডিসির মতো করে শোনেনও না বা তা পূরণও করেন না। ফলে এখানে দায়িত্বটাই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ, পদবি নয়।
সিলেট বিভাগের একজন ইউএনও জানিয়েছেন, সরকারের যেকোনও সিদ্ধান্ত প্রতিটি জেলায় ডিসির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। ইউএনওরা সেখানে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। জেলার অন্য কোনও কর্মকর্তার কাছে সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা আসে না। তাই এই মুহূর্তে পদবি পরিবর্তন নয়, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করাটাই জরুরি।
এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা একেএম শামসুদ্দিন তার একটি লেখায় বলেছেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্র-নির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণেই বলা যায়, বর্তমানে দেশে যে বিধিব্যবস্থা চালু আছে, তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করে না। বাংলাদেশের এমন শাসনব্যবস্থাই ডিসি এবং ইউএনওসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিজেদের ‘প্রভু’ এবং জনগণকে ‘প্রজা’ মনে করার সুযোগ করে দিয়েছে। …এসব আমলা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, তাদের আচরণ দেখে মনে হয় জনগণই তাদের প্রজা এবং তারা জনগণের শাসক। যদি তাই হয়, তাহলে বলবো, সংস্কার কমিশনের জেলা প্রশাসকের পদবি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তটি হবে যুগোপযোগী।”
এ প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, আমরা পদবি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছি। সরকার সে সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে কিনা বা কবে করবে সেটি তাদের বিষয়, আমাদের নয়।