Image description

ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় নিহতদের হত্যাকারীদের বিচারকার্য শুরু না হওয়ায় হতাশ ৯ শহীদ পরিবার। ঘটনার মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে এসব পরিবার।
ফেনী জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ফেনী মডেল থানায় ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। যেখানে এজাহারভুক্ত আসামি রয়েছে ২১৯৯ জন ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ৪ হাজার। তাদের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ১১ জন। কিন্তু এসব মামলার অধিকাংশ রাঘববোয়ালরা এখনও অধরাই রয়ে গেছেন। এ পর্যন্ত কতজন এজহার নামীয় আসামিকে আটক করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি।
গত ৩১ জুলাই একটি মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। 
চার্জশিটে অভিযুক্তদের মধ্যে ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী রয়েছেন।
এর মধ্যে প্রায় সব কটিতে ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীকে এবং বেশ কয়েকটিতে ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিম ও ফেনী-৩ আসনের সাবেক সাংসদ মাসুদ উদ্দিনকে এবং ১টি হত্যাকাণ্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আসামি করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন— ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, ছাগলনাইয়ার সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল, দাগনভূঞার সাবেক চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি দিদারুল কবির রতন, পরশুরামের সাবেক মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল, সোনাগাজীর সাবেক চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম পিটু ও জিয়া উদ্দিন বাবলু প্রমুখ।
আন্দোলনে শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের পিতা নেছার আহম্মদ হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক আসামি দেশের বাইরে চলে গেছে। আবার অনেকে দেশে থাকা সত্ত্বেও আইনের আওতায় আসেনি। বিচার নিশ্চিত না হলে আমাদের হাজারো সন্তানের রক্ত ও আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। কোটি কোটি টাকা বা অট্টালিকা আমরা চাই না। সন্তানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারই একমাত্র চাওয়া। আমাদের এখন আর কোনো আনন্দ নেই।’
আন্দোলনকারী আবদুল্লাহ আল-যোবায়ের বলেন, ‘প্রকৃত খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ আন্দোলনের বেদনা যেমন থাকবে, তেমনি বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে এমন ঘটনার। দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে শহীদ পরিবারকে সামান্য সান্ত্বনা দিতে।’
একাধিক হত্যা মামলার আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভুঞা বলেন, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি করে অস্ত্রধারীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি ও সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, অস্ত্রধারীরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। কিন্তু এসব মামলার ৬১৯৯ জন আসামির মধ্যে সব রাঘববোয়াল এখনও অধরাই রয়ে গেছে। পুলিশের কাজের ধীরগতির ফলে মামলার বিচারিক কাজে বাধাগ্রস্ত হচেছ। অপরদিকে আসামি গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বাদী পক্ষের (শিক্ষার্থীদের) আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া।
ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এক হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার থাকা ১১ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে একটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আসামি ধরতে ও চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সবগুলো মামলা ফেনী মডেল থানায় হওয়ায় জনবল স্বল্পতা রয়েছে বলে জানান।

উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ফেনীর মহিপাল এলাকায় উড়াল সেতুর নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলায় ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিন আনন্দপুর গ্রামের নেছার আহম্মদের ছেলে ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ (২০), সদর উপজেলার ফাজিলপুর কলাতলী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে ছাইদুল ইসলাম (১৯), পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব (১৯), সোনাগাজীর বগাদানা ইউনিয়নের মান্দারি গ্রামের আবদুল লতিফের ছেলে জাকির হোসেন শাকিব (১৯), সোনাগাজী উপজেলার ছাড়াইতকান্দি গ্রামের মো. আহসান উল্লার ছেলে মো. আব্দুর গনি (৩৮), চরচান্দিয়া গ্রামের মো. নোমান হোসেনের ছেলে মো. মাহবুবুর হাসান (২১), দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর জয়লস্কর এলাকার শাহজাহান টিপুর ছেলে সরোয়ার জাহান মাসুদ (২১), লক্ষ্মীপুর জেলার আব্দুল মালেকের মালেকের ছেলে অটোরিকশা চালক মো. সবুজ (২০) ও নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর গ্রামের মো. আবুল হাসেমের ছেলে মো. আবু বক্কর সিদ্দিক (৩৮) নিহত হন। এ সময় আরও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাচেষ্টা চালানো হয়।
শীর্ষনিউজ