Image description

পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গণ-অভ্যুত্থানের তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগে এবং পরে দুটি গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী ছিল বাংলাদেশের জনগণ। অন্য দেশের তুলনায় এই দেশের অভ্যুত্থানের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এর কারণ অভ্যুত্থানের বিস্তৃতি। নগর-শহর পেরিয়ে গ্রাম-মহল্লায়ও ছড়িয়ে পড়ে অভ্যুত্থানের উত্তাপ। গত বছরের ৫ আগস্ট তেমনি ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয় আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান, আরেকটা গণবিস্ফোরণের চিত্র। বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ কতটা ব্যাপক হতে পারে, সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্বমিডিয়া। জনতার দ্রোহের আগুনে এ দিন পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। ভেঙে পড়ে তার মসনদ। শেষ পর্যন্ত তিনি পালিয়ে ভারতে যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। আজ ৫ আগস্ট (মঙ্গলবার) পূর্ণ হচ্ছে সেই সরকার পতনের এক বছর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান গণ-অভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে খবরের কাগজকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে যে গণ-অভ্যুত্থানগুলো হয়েছে, তার মধ্যে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ব্যতিক্রম। শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে না, বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকেও এটা ব্যতিক্রম। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে মৃত্যুর সংখ্যা আমরা যদি আলাদা রাখি, তাহলে সেই অভ্যুত্থান হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে। সেখানে তিনটি জোট ছিল। জোটের বাইরে জামায়াত ছিল। অন্যরা এখানে নেতৃত্ব দিয়েছে। জোটের দলগুলোর ছাত্রসংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ছাত্রদল আলাদা প্ল্যাটফর্মে নেতৃত্ব দেয়। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব নেই। তারা সঙ্গে ছিল। এই অভ্যুত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে হলেও কারও একক নেতৃত্ব ছিল না। নব্বইয়ে আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছিল। ২৪-এর আন্দোলনে ছাত্র সমাজের সঙ্গে রাজনৈতিক দল এবং আপামর জনসাধারণ যুক্ত ছিল। নব্বইয়ে আন্দোলন ছিল নগরকেন্দ্রিক। কিন্তু ২৪-এর অভ্যুত্থান ছিল সারা দেশে বিস্তৃত একটা আন্দোলন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ মঙ্গলবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে পাঠ করা হবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সর্বস্তরের জনতার দাবি ছিল এই জুলাই ঘোষণাপত্রের। ইতোপূর্বে সরকার বেশ কয়েকবার এই ঘোষণাপত্র নিয়ে টাইমফ্রেম দিয়েছিল। যদিও সেটি পূরণ হয়নি। অবশেষে সেটার অপেক্ষা ফুরাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিকেল ৫টায় এই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। তবে অনুষ্ঠানের শুরু হবে বেলা ১১টায়। গান পরিবেশন করবে বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠী। উদযাপন করা হবে ফ্যাসিস্টের পলায়নসংক্রান্ত বিভিন্ন পরিবেশনা। এ ছাড়াও থাকবে ‘স্পেশাল ড্রোন ড্রামা’, কনসার্ট ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে উল্লেখ করেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ। এই বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে জুলাইয়ের চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বাণীতে বলেন, জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো- একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারও শহিদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনো দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। আসুন সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।

আজ ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে রাজধানীজুড়ে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। র‌্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা কঠোরভাবে নজরদারি করছেন। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে রয়েছে র‌্যাব-পুলিশের একাধিক টিম। অনুষ্ঠানস্থলের নিরাপত্তায় রয়েছে পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপি বলেছে, দিনব্যাপী অনুষ্ঠান উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ব্যাপক জনসমাগম হবে। অনুষ্ঠান চলাকালীন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের (খেজুরবাগান ক্রসিং থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত) যানবাহন চলাচল করবে না। এমতাবস্থায় ঢাকাবাসীকে কিছু এলাকার সড়ক এড়িয়ে চলাচল করার জন্য এবং কিছু পয়েন্টে ডাইভারশন মেনে বিকল্প পথে চলাচলের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে ডিএমপি। 

৫ আগস্ট ঢাকার চিত্র
ছাত্র-জনতার আন্দোলন পূর্ণতা পায় গত বছরের ৫ আগস্ট। তার আগের দিন ৪ আগস্টও প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে বেশির ভাগ ছিলেন আন্দোলনকারী। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ছিল নিহতদের তালিকায়। ৪ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় নিহত হন অন্তত ১০ জন। কারফিউর মধ্যে হাজার হাজার আন্দোলনকারী ঢাকার বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট নিয়ে আসা হয়। সেই দিনই বোঝা যায়, ৫ আগস্ট ঢাকায় জনতার ঢল নামতে পারে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, উত্তরা, ফার্মগেট, মিরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শত শত পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। তার মধ্যেও আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামেন। শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। বন্ধ ছিল মোবাইল ইন্টারনেট। ফলে মানুষ আন্দোলনের খবরও সেভাবে জানতে পারছিলেন না। সবার মধ্যে ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এলাকায় জড়ো হওয়া জনতার ওপর পুলিশ অনবরত টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। মুহুর্মুহু গুলির মুখে একপর্যায়ে শহিদ মিনার খালি হয়ে যায়। অনেকেই আহত হন। যাত্রাবাড়ীতে চলে ব্যাপক সংঘর্ষ। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। অনেকেই প্রাণ হারান সেখানে। ৩০ জনের লাশ আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এদিন সারা দেশে সহিংসতায় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। তবে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর, অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনার দিন শেষ হচ্ছে। ফলে ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ জনতা। বেলা আড়াইটার আগে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয় রাজধানী ঢাকা। ঢাকার সব পয়েন্ট থেকে জনতার স্রোত গণভবন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে যায়। হাজারও জনতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল করে নেন। জনতা ঢুকে পড়েন সংসদ ভবনেও। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছাদ এবং সংসদ ভবন চত্বরে জনতার ঢল সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে স্থান করে নেয়। এই দুই ভবনে ঢুকে তারা ফ্যাসিবাদ শাসক শেখ হাসিনার পতনে উল্লাস প্রকাশ করেন। এরপর থেকে এই ছবি দুটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে স্থান পায়। অনেকেই রং দিয়ে সেখানের বিভিন্ন দেওয়ালে খুনি হাসিনা, ছাত্র হত্যার বিচার চাইসহ নানা বক্তব্য লেখেন। ভাঙচুরও করা হয় ব্যাপক। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও নিয়ে যান তারা। লুটপাটও চালানো হয়। আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। সেদিন ঢাকায় ব্যাপক মানুষের উপস্থিতির কারণে রাস্তায় কোনো ধরনের যান চলাচল করতে পারেনি। সবাই হেঁটে হেঁটেই শেখ হাসিনার পলায়নের বিষয়টি উদযাপন করছেন। তবে অনেকের মধ্যে ছিল উদ্বেগ। অনেকের চোখেই ঝরেছে আনন্দাশ্রু। ভাঙচুর করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মারক স্থাপনাও। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যও ভাঙচুর করে তারা। সেনাপ্রধান বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিসহ অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সিদ্ধান্ত হয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী ২ গণ-অভ্যুত্থানের মিল-অমিল
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গণ-অভ্যুত্থান হয় ১৯৯০ সালে। সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও বাম রাজনৈতিক দলের সংগঠিত গণ-আন্দোলনে পদত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৮২ সালে বিএনপির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করা হয়। দীর্ঘ ৮ বছরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৯০ সালে। অক্টোবরে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি করলে ৫ জন প্রাণ হারান। পরে আন্দোলন তীব্র হলে ডিসেম্বরের ৪ তারিখ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এরশাদ। ৬ তারিখ পদত্যাগপত্র জমা দেন। বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ৫৫ দিনের আন্দোলনে ৪৪ জন প্রাণ হারান।

অন্যদিকে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাত্রা ছিল আরও ব্যাপক। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। সেটি পরে পরিণত হয় গণ-অভ্যুত্থানে। ৩৬ দিনের আন্দোলনে প্রাণ হারান হাজারেরও বেশি মানুষ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই সময় ১৪০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে।