
হঠাৎই আগুন লাগে রাজধানীর গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে। গত শনিবার (২ আগস্ট) লাগা এই আগুন ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট দুই ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে মার্কেটটির পঞ্চম তলার বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভবনের ছাদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পঞ্চম তলার ছাদ খসে পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
এমন অবস্থায় খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, এই মার্কেটে শুধু অবৈধ দোকানই রয়েছে ৫১৩টি বেশি। তিন বছর আগেই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এসব অবৈধ দোকান বসিয়ে হাজার কোটি টাকার রমরমা বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন বাণিজ্যিক এই মার্কেটটি চারতলা বিশিষ্ট। এর ওপর অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে আরও একতলা। যেখানে সারিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৩০০ দোকান। একইভাবে মার্কেটের নিচতলায় নকশাবহির্ভূতভাবে আরও শতশত দোকান তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, এসব দোকান বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও বিএনপির একটি প্রভাবশালী চক্র। কিন্তু অবৈধ দোকানি বা ওই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডিএসসিসির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের সীমানা থেকে সুন্দরবন মার্কেটের দূরত্ব ১০০ মিটারের কম। অথচ করপোরেশনের নাকের ডগায় এ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, ভোলা-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও স্থানীয় বিএনপি নেতা নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন। গণঅভ্যুথানের পর সম্রাট ও শাওন আত্মগোপনে। এখন নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন মার্কেটটির হর্তাকর্তা।
এমন পরিস্থিতিতে মার্কেটটির অবৈধ অংশে আগুন লাগলেও তা উচ্ছেদ করা নিয়ে জটিলতায় পড়েছে ডিএসসিসি।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবনের পঞ্চম তলায় শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে জানতে পেরেছি। পঞ্চম তলাসহ মার্কেটের বিভিন্ন তলায় শতশত অবৈধ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে বলে শুনেছি। এগুলো খতিয়ে দেখা হবে। বৈধ মার্কেটে কোনো অবৈধ দোকান থাকতে দেওয়া হবে না। সব অবৈধ দোকান সিলগালা করার ব্যবস্থা হচ্ছে। পরবর্তী সময় উচ্ছেদসহ করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালের দিকে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জায়গায় সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট গড়ে ওঠে। তখন থেকেই মার্কেটটি চারতলা বিশিষ্ট ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ক্রমান্বয়ে মার্কেটের সিঁড়ি, বারান্দা, হাঁটা-চলার পথ, লিফটের জায়গা, টয়লেটের স্থানে দোকানপাট গড়ে উঠতে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৪ সালের দিকে মার্কেটের পঞ্চম তলা নির্মাণ করেন যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও স্থানীয় বিএনপি নেতা নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন। পার্কিংয়ের জায়গায়ও শত শত দোকান গড়ে ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, একেক করে সব অবৈধ দোকান বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, এই মার্কেটের ভেতর এখন কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ তা দেখে বোঝার উপায় নেই। অবৈধ দোকানগুলো একেকটা ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। যারা দোকানগুলো কিনেছেন, তারা এখনো ব্যবসা করছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ও শেখ ফজলে নূর তাপস তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বর্তমান প্রশাসনও নীরব ভূমিকা পালন করছে। অথচ আজ মার্কেটটির অবৈধ অংশে আগুন লেগেছে। ভাগ্য ভালো এ আগুন অন্য তলায় ছড়িয়ে পড়েনি। দ্রুত সময়ের মধ্যে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করতে হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ওই মার্কেট পরিদর্শন করে অবৈধ দোকানপাটের একটি তালিকা তৈরি করেছে ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ। এ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পরিদর্শনে সুন্দরবনের নিচতলায় ৯৯টি, দ্বিতীয় তলায় ৪১টি, তৃতীয় তলায় ৩৭টি, চতুর্থ তলায় ৩৬টি এবং পঞ্চম তলায় ৩০০টি অবৈধ দোকান রয়েছে। এ কারণে মার্কেটটি এখন ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। বাইরে থেকে সেখানে আলো-বাতাস ঢোকার সুযোগ নেই। তাই অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদে সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগকে চিঠি দিয়েছে রাজস্ব বিভাগ। কিন্তু চিঠি পেয়েও উচ্ছেদে যাচ্ছেন না সম্পত্তি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
সম্পত্তি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এখন সুন্দরবন মার্কেটটির অবৈধ দোকানপাট নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন। তিনি একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বহু মামলা রয়েছে। তার ভয়ে করপোরেশন উচ্ছেদে সাহস করছে না।
সম্প্রতি মার্কেটটি ঘুরে দেখা যায়, সুন্দরবন মার্কেটের নিচ থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত মোবাইল এক্সেসরিজের দোকান ও গোডাউন। কিন্তু কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ তা প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই। প্রত্যেকটি দোকান সাজানো-গুছানো। তবে সিঁড়ির নিচসহ হাঁটা-চলার পথে যেসব দোকান রয়েছে, সেগুলো যে নকশার বাইরে তৈরি তা দেখলেই বোঝা যায়। আর পঞ্চম তলার সবগুলো দোকানই গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয়।
নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা হাছিবা খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এবং রাজস্ব ও প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টরা এক সপ্তাহ আগে সুন্দরবন মার্কেট পরিদর্শন করেছি। সেখানে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় অবৈধ দোকানগুলো চিহ্নিত করেছি। এখন ভেঙে দেওয়ার আগের কাজগুলো চলছে। শিগগির সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।’
তিনি বলেন, ওই মার্কেটে এখন অবৈধ এবং বৈধ দোকান প্রায় সমান। মার্কেটটির জরুরি বের হওয়ার ফটকেও দোকান তৈরি করে রাখা হয়েছে। করপোরেশনের মার্কেটে এমন অব্যবস্থাপনা চলতে দেওয়া হবে না।
তিন বছর আগেই সুন্দরবন মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস। সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় বিপজ্জনক অবস্থা ছিল। গত শনিবার আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ‘ভবনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। এছাড়া ভবনে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। এ ভবনটাকে আমরা অনেক আগে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঘোষণা করেছিলাম।’