Image description

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে পু‌লি‌শের গু‌লি‌তে আমার স্বামী জোবা‌য়ের আহ‌ম্মেদ শহীদ হন। এখন তো আমি নি‌জেই বৈষম্যের শিকার হয়েছি। স্বামীকে হারালাম, স্বামীর গৃহও হারালাম। আমি তো সব হারিয়েছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি!

 

শ‌নিবার (২ আগস্ট) সকা‌লে দৈ‌নিক নয়া দিগ‌ন্তের সা‌থে আলাপচা‌রিতায় কথাগু‌লো বল‌ছি‌লেন শহীদ জোবা‌য়ে‌রের স্ত্রী মার‌জিনা আক্তার।

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে জোবায়ের আহ‌ম্মেদ। ২০২৩ সা‌লের ২৩ জুন জুবায়েরের সাথে মার‌জিনার বিয়ে হয়।

তি‌নি ব‌লেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তির স্ত্রী-সন্তানরাই এখন সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নিহত ব্যক্তিদের রক্তের বিনিময়ে কেউ কেউ পদ পেয়েছেন, গদি পেয়েছেন। কিন্তু শহীদদের স্বজনদের এখনো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে।

মারজিনা আক্তার জানান, স্বামীর মৃত‌্যুর পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়‌লে তা‌কে ঈশ্বরগঞ্জ উপ‌জেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃ-পাচাশী গ্রামে তার বাবার বা‌ড়িতে পা‌ঠি‌য়ে দেয়া হয়। তি‌নি ওই গ্রামের শহীদুল্লাহর মেয়ে। প‌রে তি‌নি বাবার বা‌ড়ি‌তে থে‌কে সুস্থ হন। তারপর ‌থে‌কে তারা শ্বশুর-শাশুড়ি কোনো খোঁজ নেয়নি। আমি স্বামীর বা‌ড়ি‌তে যাওয়ার পরেও ভালো ব্যবহার করে নাই। স্বামীর রুহের শান্তির জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে, সেখানে যাওয়ার পর তারা খারাপ আচরণ করছে। বাড়িতে থাকতে দেয়নি। বের করে দিয়েছে। মা সাথে গিয়েছিলেন তাকে বলেছে, মেয়ের সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে যান। আর কোনোদিন আসবেন না।

তিনি আরো বলেন, এক বছর চলে গেল; আমার তো সব অন্ধকার। বিয়ের পরে দেয়া স্বর্ণালঙ্কার ছিল, সবই নিয়ে গেছে। একটু সুখের আশায় সব বিক্রি করে স্বামী ব্যবসা শুরু করলো। দোকানের মালামাল জিনিসপত্র, সহায়-সম্পদ সবই তাদের হয়ে গেল। আমি তো এখন শূন্য! স্বামীর সম্পদ বলতে, তার ঘ্রাণ নেয়ার জন্য ‘বিয়ের পাঞ্জাবিটা, একটি টি-শার্ট আর একটি টাওয়াল’ নিয়ে এসেছি।

মারজিনা আক্তার বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমার স্বামী শহীদ হলেন, এখন তো আমিও বৈষম্যের শিকার হয়েছি। শুনেছি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা অনুদান দিচ্ছে; কেউ তো আমার খবর নেয় না। আমার স্বামী হারিয়েছি, আমি তো সব হারিয়েছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি!

গতবছর ২০ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে উপজেলার কলতাপাড়ায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জোবায়ের আহম্মেদ। সেদিন স্ত্রীর কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়েছিলেন। ওইদিন স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর গৃহও হারাতে হয়েছে স্ত্রী মারজিনা আক্তারকে। সেদিন স্বামীর লাশ দেখে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন মারজিনা আক্তার। একপর্যায়ে তার হাত-পায়ের শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। সুচিকিৎসার জন্য তাকে চলে যেতে হয় বাবার বাড়িতে।

মারজিনার বাবা মো: শহীদুল্লাহ জানান, মেয়ের জামাই নেই; মেয়ে অসুস্থ। মেয়েকে সুস্থ করার জন্য একেকবার একেক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। সে তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার ২ ছেলে আর ৩ মেয়ের মধ্যে সে ৪র্থ। তাকে ভালো করার জন্য পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা তখন ব্যয় হয়।

শহীদ জোবায়ের আহম্মেদের শাশুড়ি মোছা: মনোয়ারা খাতুন বলেন, ৪০ দিনের মিলাদ অনুষ্ঠান ছিল। আমরা যাওয়ার পর তারা (মারজিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন) ভালো ব্যবহার করে নাই। মেয়েটার তারা খোঁজও নেয় না, নিয়ে যাওয়ার পর সেই বাড়িতে ঠাঁইও দেয়নি। তারা কখনো এ কথা বলে না যে জোবায়ের নেই; তুমি তো আছো, থাকো আমরা তো আছি। বরং কেন গেছে, কেন গেল; যা আছে সবকিছু নিয়ে বেড়িয়ে যান- এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আমাদের বের করে দিয়েছেন।

শহীদ জোবায়ের আহম্মেদের বাবা আনোয়ার উদ্দিন জানান, আমি ছেলে হারিয়েছি। পুত্রবধূকে এখানে আমি কিভাবে রাখব, ওর তো নিরাপত্তার দরকার আছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওর বাবার বাড়িতে যেতে বলেছি। আমি তার পরিবারকে বলেছি, সে তো স্বামীর মোহরানা পাবে। পরবর্তীতে বিয়েশাদি হলে তখন সহযোগিতা করা হবে।

তিনি বলেন, পুত্রবধূ আমার ছেলের পাসপোর্ট চায়, ওর ভোটার আইডি কার্ড চায়, এগুলো নিয়ে সে কী করবে? এসব নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে।

উল্লেখ‌্য, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ২০ জুলাই গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় তিনজন শহীদ হন। তারা হলেন- ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে বিপ্লব হাসান, রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের ছেলে নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব ও মইলাকান্দা ইউনিয়নের কাউরাট গ্রামের আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে জোবায়ের আহম্মেদ।

কোটাবিরোধী প্রত্যেকটি আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিজের দোকান বন্ধ করে ময়মনসিংহ চলে যেতেন জোবায়ের আহ‌ম্মেদ। শম্ভুগঞ্জ এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে তিনি পুরাতন মোবাইল কিনে তার যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। একপর্যায়ে ব্যবসার পরিধি ব্যাপক হলে তিনি নিজে ভারত ও চীন থেকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানি এবং নতুন মোবাইল ফোন আমদানি করতেন। এছাড়া পুরাতন মোবাইলের যন্ত্রাংশও রফতানি করতেন তিনি। তার আয়ে পুরো সংসারটি ঘুরে দাঁড়ায়।