
বিদ্যুৎ এসেছে, ঘরে মোবাইল ফোনও আছে, কিন্তু সন্তানকে পাঠানো যাচ্ছে না স্কুলে। রোগ হলে হাসপাতালে যাওয়া দূরের কথা, বিশুদ্ধ পানি বা শৌচাগার ব্যবস্থাও নেই। এমন জীবনযাপনই বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বাস্তব রূপ। আর এমন অবস্থায় বাস করছে বাংলাদেশের অন্তত চার কোটি মানুষ। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসূচক অনুযায়ী, আয় দিয়ে দারিদ্র্যের একটি দিক বোঝা গেলেও প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি বিস্তৃত। এটি শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাপনের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে।
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ ২০১৯ সালের বহু নির্দেশক সমীক্ষা (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে) থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সূচক তৈরি করেছে।
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, দারিদ্র্য শুধু টাকা না থাকার নাম নয়। মানুষ হয়তো সামান্য আয় করছে, কিন্তু তার সন্তান স্কুলে যাচ্ছে না, চিকিৎসা পাচ্ছে না, বিশুদ্ধ পানি বা নিরাপদ ঘরও নেই। তারা বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার।
এই সূচকে তিনটি প্রধান মাত্রা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তাহলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমান। প্রতিটি বিভাগের মধ্যে আবার রয়েছে নির্দিষ্ট সূচক। কোনো ব্যক্তি যদি অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সূচকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাকে বহুমাত্রিক দরিদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা : ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশ, যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই হার ২১ শতাংশ।
এই উন্নয়নের পেছনে অবদান রেখেছে বিদ্যুৎ সুবিধা, ঘরবাড়ির মানোন্নয়ন, স্যানিটেশন ও সম্পদের মালিকানা বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন কর্মসূচি।
গ্রাম ও শহরের বৈষম্য চোখে পড়ার মতো
শহরে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশ হলেও গ্রামীণ এলাকায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশে। বিভাগভিত্তিক হিসাবে খুলনায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম ১৫ শতাংশ। সিলেটে তা ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
জেলাভিত্তিক চিত্র আরো উদ্বেগজনক
বান্দরবানে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে দুইজনই দারিদ্র্যের শিকার। কক্সবাজার ও সুনামগঞ্জেও এই হার ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে, ঝিনাইদহে এই হার মাত্র ৯ শতাংশ।
বঞ্চনার প্রধান সূচকগুলো
শিশুদের স্কুলে না যাওয়া, কম শিক্ষাবর্ষ, অপুষ্টি এবং বসবাসের অযোগ্য ঘরবাড়ি-এসব সূচক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে ঘরের অবস্থা, ইন্টারনেট সংযোগ ও স্যানিটেশন—এই তিনটি খাতে দেশব্যাপী ২০ শতাংশের বেশি মানুষ দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত।
জিইডি সচিব ড. মনজুর হোসেন বলেন, এই সূচক জেলা ও বিভাগভিত্তিক বৈষম্য চিহ্নিত করে দেয়। ফলে যেসব এলাকায় দারিদ্র্যের মাত্রা বেশি, সেখানে লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব হবে। সরকারি বিনিয়োগ এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্পগুলো এই তথ্য অনুযায়ী সাজানো হলে আরো ফলপ্রসূ হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করবে।
এই সূচক প্রকাশে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ সহযোগিতা পেয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ বাংলাদেশ) এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়ন উদ্যোগ’-এর (অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ)।