
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ প্রত্যয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে দলটি।
রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের রূপরেখায় এক নতুন সম্ভাবনার নাম হয়ে ওঠে এনসিপি। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর পর ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনের পতনে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র কাঠামোর স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল সাধারণ মানুষ। তরুণ প্রজন্মের কাছে এনসিপির আবির্ভাব তাই এক ধরনের প্রত্যাশা ও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছিল।
বহুদলীয় রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে একটি বিকল্প শক্তির আবির্ভাব নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প খোঁজার যে চেষ্টা নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং তরুণদের মধ্যে কয়েক দশক ধরেই চলছিল, এনসিপি সেই প্রত্যাশাকে ধারণ করেই আবির্ভূত হবে বলে আশা ছিল বুদ্ধিজীবী থেকে জনসাধারণের।
তরুণ জনগোষ্ঠী এখন দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৭ শতাংশ। মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, এই বিরাট জনসংখ্যা যদি এনসিপির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে বড় দুই রাজনৈতিক দলের শক্ত অবস্থানেও চিড় ধরাতে পারবে। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা! আত্মপ্রকাশের পাঁচ মাস না যেতেই দলটির রাজনৈতিক দর্শন, নৈতিকতা এবং সাংগঠনিক পরিপক্বতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে জনগণের বুকভরা আশা কি তবে এক নিষ্ফল বিশ্বাস হয়ে থাকবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে বিপ্লব পরবর্তী মানুষের প্রত্যাশা হোঁচট খেয়েছে। সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রটোকলে সভা-সমাবেশ করার অভিযোগ উঠেছে এনসিপির বিরুদ্ধে। এ ছাড়া নানা দুর্নীতি, নারী হেনস্তা এবং অনিয়মের সঙ্গে সংগঠন এবং নেতৃবৃন্দের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় এনসিপির প্রতি মানুষের অভিমানও দিনকে দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। শুরুতে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। দিন যত গড়াচ্ছে, মানুষের সেই প্রত্যাশায় ভাটা পড়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগের চাপে দল
এনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধে উঠে আসা একের পর এক অভিযোগ দলটির ইমেজ সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ। দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক তদবির বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশের সর্বত্রই ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। দলের অভ্যন্তরে সমন্বয়হীনতা ও অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ নতুন নয়। আত্মপ্রকাশের পর থেকেই এনসিপি নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে, যা জনআস্থা হ্রাসে বড় ভূমিকা রেখেছে। তরুণদের প্রত্যাশা নিয়ে গড়ে ওঠা দলটি এখন হতাশার প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব এবিএম গাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ। তাকে বহিষ্কার ও দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ হলেও পরবর্তী সময়ে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে। এনসিপির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে অডিও কল ও বার্তা ফাঁসের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়লেও দলের পক্ষ থেকে কেবল কারণ দর্শানোর নোটিশেই সীমাবদ্ধ থাকা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও এনসিপি নেতা আতিক মোর্শেদের বিরুদ্ধে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ থেকে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তার স্ত্রীকেও ‘নগদে’ চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়, তবে এক্ষেত্রেও কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে, সম্প্রতি গুলশানে এক এমপির বাসায় চাঁদা তুলতে গিয়ে ধরা পড়েন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা রিয়াদসহ পাঁচজন; সেখান থেকে উদ্ধার হয় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনের সাবেক নেত্রী উমামা ফাতেমা বলেন, “অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক নেতাদের প্রটোকলে জড়িত ছিলেন এবং গুলশান-বনানীর গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে আগে থেকেই অভিযোগ ছিল। ”
এদিকে বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ড. এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা ইমামুর রশিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক নারীর কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করলে তা ভাইরাল হয়। অন্যদিকে, চট্টগ্রামে দুটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘বিক্ষোভের নামে মবসৃষ্টির’ অভিযোগও এনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কনসার্ট আয়োজনের জন্য এনসিপির এক নেতার ৭৬ লাখ টাকা চাঁদা দাবি ও ভাইস চ্যান্সেলরের সুপারিশপত্র প্রকাশের পর সামাজিকমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গত ২৮ জুলাই রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে লিখেছেন, তাকে ঘিরে একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে এবং এর পেছনে ‘নতুন একটি দলের কয়েকজন মহারথী’ জড়িত। পরে আবার এটি এডিট করে নতুন একটি দলের জায়গায় বিভিন্ন দলের কয়েকজন মহারথী জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন। তার এই পোস্টকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানারকম জল্পনার।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতির দায়ে তার পিএসকে বরখাস্ত করলেও এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি এখনো উপদেষ্টা পদে বহাল রয়েছেন। এ ছাড়া এসব বিষয়ে তাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। কুমিল্লাতে আসিফের বাবা নানান অনিয়ম দুর্নীতি করছেন, এরকম খবরও মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না, যা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে।
সরকারের বাড়তি সুবিধা, সমালোচনায় রাজনৈতিক নেতারা
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করে স্পষ্ট পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা ও বিশ্লেষকরা। ফ্যাসিবাদের পতনের পরও সরকারের এমন আচরণকে ঘিরে প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও সমতাভিত্তিক আচরণ নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারাই কি নতুন বাংলাদেশে নতুন করে বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে?
গত ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার ডাকে আয়োজিত এক বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক নেতারা এ বিষয়ে সরাসরি তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠক শেষে ১২ দলীয় জোটের প্রতিনিধি শাহদাত হোসেন সেলিম এনসিপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, কিছু দল বিভিন্নভাবে সরকার বা প্রশাসনের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এসব বৈষম্য বন্ধ হওয়া উচিত। ”
একই সুরে কথা বলেন এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদও। তার ভাষায়, “সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ। এনসিপিকে নানাভাবে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ”
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, “এনিসিপির বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে সরকার। এমন হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বাংলানিউজকে বলেন, “একটি বিশেষ দলকে এই সরকার নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে অনেকে মনে করেন। এর ফলে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে। এ সরকার নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করছে না, ফলে নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। ”
জনতার দ্বারে এনসিপি, প্রশ্নের মুখে গ্রহণযোগ্যতা
গত ৩০ জুন ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শুরু করেছিল এনসিপি। মাসব্যাপী এই কর্মসূচিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা দেশের ৬৪টি জেলায় সফর করে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কবর জিয়ারত, সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগে অংশ নেন। আত্মপ্রকাশের মাত্র চার মাসের মাথায় এমন বৃহৎ কর্মসূচি গ্রহণ করাকে অনেকেই সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তবে পদযাত্রার মাধ্যমে সংগঠনটির জনপ্রিয়তা বাড়লেও বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি তারা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি নিরাপত্তা ও প্রটোকলের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হয়েছে, রাস্তা বন্ধ করে সভা আয়োজন করা হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জোর করে শিক্ষার্থীদের সমাবেশস্থলে আনা হয়েছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দল এমনও দাবি করেছে যে, এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে লোক সরবরাহ করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে যেসব মানুষ রাজনীতিতে অনাগ্রহী, যাদের কাছে রাজনীতি মানে ক্ষমতার খেলা, এনসিপিকে তাদের পক্ষে কথা বলার বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠ হয়ে উঠতে হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দলটি দক্ষিণপন্থি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে। বিভিন্ন সমাবেশে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে এনসিপি নেতাদের একই মঞ্চে দেখা যাচ্ছে, এমনকি নানা ইস্যুতে তাদের সুরেও কথা বলছে এনসিপি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থেকে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পতন ঘটালেও বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত ভোটাধিকার ফেরাতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও জামায়াতে ইসলামীর মতো গড়িমসি অবস্থানে দেখা গেছে এনসিপিকে।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর সমালোচনা করে মন্তব্য করেন, এনসিপি রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, “২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী হয়েছে। এখন দক্ষিণপন্থিদের প্রভাব বেড়েছে। তাদের একটা উত্থান হয়েছে এখন। ছাত্রদের নেতৃত্বে যে পার্টি হয়েছে, সে পার্টির বক্তব্যে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ নিয়ে কোনো কথা নাই। তারা (এনসিপি) ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করবে। সেজন্য তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ”
এনসিপির আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক ও টিএসসিভিত্তিক রাজনীতির অভিযোগ থাকলেও, এই পদযাত্রার মাধ্যমে দলটি জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু বিতর্ক ও প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব এনসিপির
এনসিপির নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও সহনশীলতার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এনসিপির উচিত সরকারের ওপর নির্ভর না করে স্বনির্ভর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করা। গোপালগঞ্জ ও কক্সবাজারের ঘটনা তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব প্রমাণ করেছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “গোপালগঞ্জের ঘটনা এনসিপির রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার ফল। তাদের জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে কেন ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হয়ে গেল এটি একটি বড় প্রশ্ন। সব মিলিয়ে তাদের বেপরোয়া ভাব রাজনৈতিক অঙ্গণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এটি কি তাদের পরিকল্পিত নাকি অনভিজ্ঞতা তাও ভেবে দেখতে হবে। অনেকেই মনে করেন নির্বাচন পেছানোর জন্য তারা পরিকল্পিতভাবেই দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে এসব করছেন। ”
সম্প্রতি বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে এনসিপির নেতাদের নানা ধরনের বক্তব্যকেও রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্বতা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এনসিপির নেতৃবৃন্দ তরুণ, কিন্তু এখনো কেউ ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি৷ যা একটি রাজনৈতিক দলের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, “জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি এনসিপির জন্য একটি যথার্থ কর্মসূচি বলেই মনে করি। তবে এই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে কোনো স্থানে তাদের যে বেপরোয়া ভাব, তা রাজনৈতিক সহনশীলতা বা প্রজ্ঞার অভাব বলেই মনে হয়। জুলাই পদযাত্রাকে ঘিরে গোপালগঞ্জে, কক্সবাজারে ও নেত্রকোনায় যা ঘটেছে এর দায় এনসিপিকেই নিতে হবে। গোপালগঞ্জ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। আমি তাকে নাই মানতে পারি। কিন্তু তার জন্মস্থানের লোকজন তো তাকে ভালোবাসে। এটাকে তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। তেমনি কক্সবাজারেও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেখানে গিয়ে তাকে গডফাদার বলে কটূক্তি করলে পাটকেল তো খেতেই হবে। ”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বাংলানিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, “এনসিপির রাজনীতি নিয়ে কথা বলার এখনো সময় আসেনি। তারা সবাই ছোট মানুষ। তাদের বোঝার জন্য আরেকটু সময় দেওয়া দরকার। তবে আমি মনে করি, তাদের আরু কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে দরকার, যাদের নিয়ে তারা একটা উপদেষ্টামণ্ডলী রাখতে পারে, যারা তাদের দিক-নির্দেশনা দেবেন। তাদের রাজনীতিকে এখন আমার কাছে কিছুটা ছেলেমানুষি মনে হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে তারা সম্ভবত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এমনিতেই তাদের ম্যাচিউরিটি কম। এজন্য কিছু ম্যাচিউর মানুষ তাদের জন্য প্রয়োজন। তাদের নামে এমনিতেই নানা ঘটনা ছড়াচ্ছে, ফলে তাদের রাজনৈতিকভাবে দাঁড়াতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। ”
তিনি আরও বলেন, “তাদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা আমি মনে করি তা ঠিক হয়নি। বোঝার আগেই তাদের এই সরকার থেকে অনেককিছু দেওয়া হয়েছে। পায়ের নিচে মাটি শক্ত হওয়ার আগেই তারা অনেককিছু পেয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিকভাবে তাদের ক্ষতি হয়েছে বলে আমি মনে করি। ”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, এনসিপির নেতাদের মধ্যে বিভক্তি লক্ষণীয়। একদল মধ্যপন্থি ও র্যাডিকাল অবস্থান নিতে চায়, অন্যরা প্রগতিশীলতার নামে উগ্রতার পথে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের মূল চেতনার বিরুদ্ধে কিছু নেতিবাচক মন্তব্য দলের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ ছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, দলে কিছু বিত্তশালী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তির উপস্থিতি রয়েছে, যারা জুলাই আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নন। এই কারণেই এনসিপি এখনই জাতীয় বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনীতিতে কোনো শর্টকাট নেই, এটি সময়সাপেক্ষ প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতার খেলা। এনসিপি নেতৃত্বের উচিত এখনই রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল সুর বুঝে নেওয়া এবং এমন কোনো যাত্রা শুরু না করা, যা বাস্তবায়ন এখন প্রায় অসম্ভব। বরং এ বিষয়ে তারা বিএনপিকে এগিয়ে রাখছেন।
এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, “বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি হয়েছে তাতে বিএনপিকে মনে হচ্ছে সবচেয়ে প্রগতিশীল। তারাই কিছু কথাবার্তা বলছে। যে সমস্ত শক্তি এখন সামনে এসেছে তাদের প্রগতিশীল বলা চলবে না। ”
এনসিপির সামনে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ রাজনীতিতে আগ্রহী হলেও নানা কারণেই তারা ক্লান্ত ও হতাশ। তাদের প্রত্যাশা শুধুমাত্র নতুন মুখের নয়, বরং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃত পরিবর্তন। তাই তাদের কেবল স্লোগান বা কথার নতুন মোড়কে মুগ্ধ করা সম্ভব নয়; তরুণদের মন জয় করতে হলে প্রয়োজন বাস্তব ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ।
একটি জরিপে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের অধিকাংশই রাজনীতিতে আস্থা রাখেন, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাদের দাবি, রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের সেবায় নিবেদিত, ক্ষমতার জন্য নয়। যদিও তরুণরা রাজনৈতিকভাবে অসন্তুষ্ট, কিন্তু রাজনৈতিকভাবেই তারা পরিবর্তন চায়। এনসিপি সেই পরিবর্তনের বাহক হতে পারে, যদি তারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়, আদর্শিকভাবে সুস্পষ্ট হয় এবং তরুণদের সত্যিকারের অংশীদার করে। এনসিপির কাছে এটি একটি সুযোগ, তবে চ্যালেঞ্জও।
এনসিপির তরুণ সদস্যদের সক্রিয়তা দেখা গেলেও এর প্রভাব এবং গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দলটি সামাজিক মাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলছে, কিন্তু এসব সংগঠন ‘অরাজনৈতিক ছাত্রসমাজ’ হিসেবে পরিচিত হলেও আদতে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা তরুণদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তরুণদের আস্থা অর্জনের জন্য এনসিপিকে স্বচ্ছতা ও সততার দিক থেকে সুনিশ্চিত হতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নানা অভিযোগে এনসিপির ব্যর্থতা শুধু একটি দলের পতন নয়, বরং তা নতুন বাংলাদেশের ধারণাকে আঘাত করার শামিল। তরুণ নেতৃত্বের ব্যর্থতা মানে একটি সম্ভাব্য বিকল্প ব্যবস্থার ভেঙে পড়া। তারা আশঙ্কা করছেন, এনসিপি হেরে গেলে, হেরে যাবে গোটা বাংলাদেশ!