
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এক সাধারণ পাপস বিক্রেতা শাজাহান। জীবিকার তাগিদে ভোলার দৌলতখান উপজেলার ছোটধলী গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন তিনি। রাজধানীর কামাঙ্গারির চরে ভাড়া বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন শাজাহান, ছিলেন স্বল্প আয়ের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ চলছিল। ঠিক সেই সময় রাস্তার পাশে বসে পাপস বিক্রি করছিলেন শাজাহান। হঠাৎ করেই পুলিশের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হন। গুলি তার ডান নাক ভেদ করে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষ রক্ষা হয়নি—শাজাহান মৃত্যুর কাছে হার মানেন।
শাজাহানের মৃত্যু শুধু একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, তা একটি অসহায় পরিবারের ভরনপোষণের শেষ আশাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী ফাতেহা ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃস্ব হয়ে পড়া এই নারী শ্বশুরবাড়ি থেকেও আশ্রয় না পেয়ে ফিরে যান বাবার বাড়ি—ভোলার দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ছোটধলী গ্রামে। বাবাহারা ফাতেহা এখন বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গেই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
২০২৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্ম নেয় শাজাহান ও ফাতেহার একমাত্র সন্তান ওমর ফারুক। বাবার মুখ না দেখেই বড় হচ্ছে শিশুটি, মায়ের কোলে। কিন্তু তাদের জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা ও অভাবের কালো ছায়া।
শাজাহানের স্ত্রী ফাতেহা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামী কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কোনো অপরাধীও ছিলেন না। তিনি শুধু রাস্তায় বসে পাপস বিক্রি করছিলেন। তবুও তাকেই গুলি করা হলো। কেন? আমি এর বিচার চাই। যারা আমার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, তারা আজও ধরা পড়েনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি কোনো অনুদান এখনো পাইনি। জেলা প্রশাসক মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেন, কিছু সহায়তা দেন। তবে যে ১০ লাখ টাকার সরকারি অনুদানের কথা বলা হয়েছিল, সেটা কবে পাবো, জানি না।’
ফাতেহা প্রশ্ন তোলেন, “আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী? তাকে কীভাবে বড় করবো? কোনো আয় নেই, কোনো ভরসা নেই। সরকারের কাছে আমি বিচার চাই, চাই ক্ষতিপূরণও।”
ফাতেহার মা বিবি নবিশা বলেন, ‘অনেক কষ্টে দিন চলছে। কোনো দিন দুবেলা খেতে পারি, কোনো দিন পারি না। ভালো-মন্দ কিছুই খেতে পারি না। মেয়ের জন্য কষ্ট লাগে, নাতির মুখের দিকে তাকাতেও ভয় লাগে।’ বড় বোন ফাতেমা বলেন, ‘আমাদের পরিবারটি এখন পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে। কেউ খোঁজ নেয় না, সাহায্য করে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, ‘ওয়ারিশ সংক্রান্ত কিছু জটিলতা ছিল, এজন্য অনুদান দিতে বিলম্ব হয়েছে। তবে এখন বিষয়টি সমাধান হয়েছে। কাগজপত্র পেলেই দ্রুত সহায়তা দেওয়া হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও সময়-সময়ে খোঁজ নিয়েছি ও সহায়তা করেছি।’
শহীদ শাজাহানের পরিবারের দাবি—এ মৃত্যু কেবল দুর্ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অবহেলার জ্বলন্ত উদাহরণ। তাদের মতে, মর্যাদা ও মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিতে হলে শুধু সহানুভূতি নয়, দ্রুত এবং যথাযথভাবে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দেওয়াই একমাত্র ন্যায্যতা। নইলে ওমর ফারুকের শৈশবের গল্প হয়ে উঠবে অনাহার, অনিশ্চয়তা আর রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার এক নির্মম দলিল।