
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর শেষ হতে চলেছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনের আওয়াজ উঠে গেছে। সব ঠিক থাকলে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণামতো, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
দেশের বৃহত্তম দল জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৬ বছর ধরে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাদের জোট শরিক ও সমমনা দলগুলোও যুগপৎ আন্দোলনে ছিল। অবশেষে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যত্থানে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
আগামী নির্বাচন ঘোষিত সময়ে হবে কি না, নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ কতটা, নির্বাচনের পর কী ধরনের সরকার দেশে অধিষ্ঠিত হতে পারে, এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। বিশেষ করে সম্ভাব্য বিজয়ী দল হিসেবে বিএনপির দিকে তাকিয়ে মানুষ। দলটি নির্বাচন নিয়ে প্রায় শঙ্কা প্রকাশ করে, একই সঙ্গে বলে আসছে তারা সরকার গঠন করবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। দেশ ও জাতির কল্যাণেই জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
একটি পত্রিকাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সেই কথাই আবার বললেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাক্ষাৎকারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ঢাকাটাইমসের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি প্রায় হুবহু তুলে দেওয়া হলো।
প্রশ্ন: দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: যাঁরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। যাঁরা বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হননি। আমার মনে হয় না তাঁরা এখনো খুব বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন প্রধান শক্তি। তার পরই রয়েছে জামায়াত, এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, নাগরিক ঐক্য এবং অন্যান্য দল।
প্রশ্ন: বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মির্জা ফখরুল: অর্থনীতি ভঙ্গুর। এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তার ওপর মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের ওপর আরও প্রভাব ফেলবে।
প্রশ্ন: নির্বাচন নিয়ে কি কোনো সংশয় বা অনিশ্চয়তা আছে?
মির্জা ফখরুল: এ মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো ভয় নেই। আমরা অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনি প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি না। যেখানে আওয়ামী লীগ নেই, সেখানে আমরা কোনো চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি না।
প্রশ্ন: নির্বাচনের পর বিএনপি ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। এ ঘোষণা কি এখনো ঠিক আছে? কীভাবে সম্ভব?
মির্জা ফখরুল: সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তো আর একটি জাতীয় সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। যাঁরা আমাদের সঙ্গে আন্দোলন ও সংগ্রামে ছিলেন, যাঁরা আমাদের সঙ্গে একমত তাঁদের নিয়েই ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটি গঠিত হবে। আমরা মূলত প্রস্তাবিত সব সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভাষণের মূল চেতনা এটাই যে আমরা একসঙ্গে এ সংস্কার বাস্তবায়ন করব।
প্রশ্ন: আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে বিএনপি কোন কোন রাজনৈতিক দলকে কয়টি করে আসন ছাড় দিতে পারে। সব মিলে সারা দেশে সর্বমোট কয়টি আসনে ছাড় দেবে আপনার দল?
মির্জা ফখরুল: যখন এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে তখন আমরা এ নিয়ে কথা বলব। আমরা এখনো এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করিনি।
প্রশ্ন: প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচনের কথা বলছেন, নির্বাচনের জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন?
মির্জা ফখরুল: আমরা আমাদের সর্বশেষ ভরসাস্থল জনগণের কাছে যাচ্ছি। জনগণের কাছে গিয়ে আমাদের ৩১ দফা প্রকাশ করছি। যদি আমরা নির্বাচিত হতে পারি, তাহলে এ কাজগুলো করব। তার মধ্যে আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি হচ্ছে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করব। দক্ষ জনবল তৈরির চেষ্টা করব।
প্রশ্ন: বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। আপনি কী মনে করেন?
মির্জা ফখরুল: এখানে একটা ভ্রান্ত মতবাদ জানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্যই আন্দোলন হয়েছে বা বিএনপি আন্দোলন করেছে। আমরাই তো প্রথম রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের কথা বলেছি। তাহলে কী করে আমাদের ব্লেম করতে পারেন যে আমরা এটা চাই না!
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১১ মাসের পারফরম্যান্স কী? আপনার দৃষ্টিতে কতটা সফল কিংবা ব্যর্থ?
মির্জা ফখরুল: অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের কর্মক্ষমতা ভালো। উদাহরণস্বরূপ, তারা সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় কাজ করেছে। মাত্র এক বছর হয়েছে, কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, শেখ হাসিনার পাশাপাশি দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও বিচার করা উচিত?
মির্জা ফখরুল: গণহত্যা এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি তারা দল হিসেবে ক্ষতি করে থাকে, তাহলে তাদের বিচার হওয়া উচিত। আমরা সব সময় আওয়ামী লীগের বিচার চেয়েছিলাম এবং এখনো চাই। কারণ আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বিচার অব্যাহত থাকবে।
প্রশ্ন: মবতন্ত্র চলছে, এদের বিরুদ্ধে আপনারা দলীয়ভাবে কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা নেবেন কি না?
মির্জা ফখরুল: দেশে বর্তমানে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোনো মূল্যে এটি বন্ধ করতে হবে।
প্রশ্ন: গণ অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে এসে গণ অভ্যুত্থানের শরিকদের মধ্যে চরম বিভক্তি ও মতবিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে?
মির্জা ফখরুল: এটার কারণ হলো বিএনপি একটা পুরোনো অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল। আন্দোলন, নির্বাচন, সরকার পরিচালনা সবকিছুতেই আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে দেশের ব্যাপারে, সরকার গঠনের ক্ষেত্রে। তা ছাড়া সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও রয়েছে। আমরা ২০১৬ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছি। আমাদের এ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বক্তব্যগুলো নতুন দলগুলো নিতে পারছে না। অনেকে আবার তাদের দলের ও নির্বাচনি কৌশল হিসেবেও সংসদে বিরোধী দলের জায়গাটা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব সমস্যা মিটে যাবে, সংস্কার ইস্যুগুলোও শেষ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক এ বিভাজন বা মতবিরোধ কি আবারও পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ফেরার পথ সুগম করে দিচ্ছে?
মির্জা ফখরুল: কখনোই না। আমি মনে করি সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। এ বিভক্তি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, যেখানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ডেকে আনবে। তবে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। এ জায়গায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রশ্ন: লন্ডন বৈঠকে আসলে কী কথা হয়েছিল, এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু প্রকাশ করা হয়নি।
মির্জা ফখরুল: কোনো সন্দেহের কিছু নেই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা বসেছেন। ভবিষ্যতে সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যাবে, দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, যে রাজনৈতিক অবস্থা, সোশ্যাল কন্ডিশন, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের পর ঋণের বোঝা সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনটা কখন যৌক্তিক হবে, সে ব্যাপারে তাঁরা অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেছেন এবং আমাদের নেতা প্রমাণ করেছেন ‘হি ইজ এ স্টেটসম্যান’। ঠিক সময় ঠিক বৈঠকটা করে তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কোচিত যে ভূমিকা রাখা উচিত, সে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন জাতির প্রয়োজনে।
প্রশ্ন: দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে আসার ব্যাপারে কোনো সময় নির্ধারণ করা হয়েছে কি না?
মির্জা ফখরুল: সময় নির্ধারণ এখনো হয়নি। এখনো তাঁর নামে একটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাটি চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে গেলে তিনি শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন বলে আমরা আশা করছি।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের রাজনীতিতে ডানপন্থিদের উত্থান হতে যাচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?
মির্জা ফখরুল: আমিও এটা দেখে রীতিমতো উদ্বিগ্ন। আমি বাংলাদেশকে সব সময় একটা সত্যিকার অর্থে উদারপন্থি গণতান্ত্রিক হিসেবে দেখতে চাই এবং এখানে গণতন্ত্র হবে সবচেয়ে বড় বিষয়। সে জায়গায় যদি এখন এমন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়, যারা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েই করে না। আবার তারা নিজেরা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় মতবাদ, এটা নিঃসন্দেহে অ্যালার্মিং সিচুয়েশন। কিছু কিছু দলের মধ্যে এমনও কথা আছে যে মহিলাদের তারা কিছুতেই সামনে আনতে চায় না। মহিলাদের তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, সামাজিক ক্ষমতায়নও করতে চায় না। এসব দলের যদি উত্থান হয় এ দেশে, তাহলে তো পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।
প্রশ্ন: ভিন্নমতের দমন দেশে উগ্রবাদের উত্থান ঘটাতে পারে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর এমন উত্থানের কিছু কিছু আলামতও এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এর দায় কাকে দেবেন?
মির্জা ফখরুল: এ দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের। এক নম্বরে শেখ হাসিনা দায়ী। আমরা বারবার তাঁকে সতর্ক করেছি, ওই দেশকে সতর্ক করেছি যে একটি সেন্ট্রিস্ট দল, গণতান্ত্রিক দল বিরোধী দলকে (বিএনপি) কখনোই দমন করে শেষ করে দিয়েন না। তাহলে ডানপন্থিদের উত্থান হবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজকে ঘটনাটা সেদিকেই যাচ্ছে।
প্রশ্ন: দেশ, জনগণ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আপনার শেষ আহ্বান কী?
মির্জা ফখরুল: দেশবাসীর কাছে আমার একমাত্র আবেদন-দেশকে ভালোবাসুন, গণতন্ত্রকে তার গতিতে চলতে দিন এবং আইন নিজের হাতে না তুলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দিন।
(ঢাকাটাইমস