Image description
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, বিআরইবি ১১ ও ৩৩ কেভি এসিআর ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ

দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) এক কর্মকর্তার অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানই বাগিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার কাজ। বিআরইবির কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তার যোগসাজশে এই কর্মকর্তার অনভিজ্ঞ সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহকারী সাজিয়ে নিম্নমানের প্রযুক্তিনির্ভর বৈদ্যুতিক প্রটেকশন ডিভাইস ‘অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার (এসিআর)’ ক্রয় বাণিজ্যের ছক তৈরি করা হচ্ছে।

বিআরইবি সম্প্রতি ১১ কেভি ও ৩৩ কেভি এসিআর ক্রয়ের জন্য দুটি স্থানীয় দরপত্র আহবান করে। প্রযুক্তিনির্ভর বৈদ্যুতিক প্রটেকশন ডিভাইস ‘অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার (এসিআর)’ সরবরাহের কার্যাদেশ নিয়ে শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিআরইবির বিরুদ্ধে।

আরইবির সহকারী পরিচালক (অর্থ) রাশেদুল হাসানের নিজের একটি নামসর্বস্ব কম্পানি ‘এমআরবিআর করপোরেশনকে এসিআর কেনার কাজ দিতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে একটি চক্র। অতীতেও অনভিজ্ঞ কম্পানিকে এসিআর কেনার কাজ দেওয়ায় বিআরইবিকে বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এসিআর হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর বৈদ্যুতিক প্রটেকশন ডিভাইস, যা বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত জরুরি হলেও কিছু কর্মকর্তা তাঁদের নিজেদের লাভের স্বার্থে মালপত্র ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিআরইবি দুটি আলাদা প্যাকেজের আওতায় পিবিএসএফ/২৪-২৫/জি-৭২ ও পিবিএসএফ/২৪-২৫/জি-৭৩-১২০টি ১১ কেভি এবং ১০০টি ৩৩ কেভি এসিআর কেনার জন্য স্থানীয়ভাবে দরপত্র আহবান করে। এসব দরপত্রে অংশ নেয় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আরইবির কর্মকর্তা রাশেদুল হাসানের প্রতিষ্ঠান ‘এমআরবিআর করপোরেশন’ দক্ষিণ কোরিয়ার বিএইচ সিস্টেম কো. লিমিটেডের পণ্য সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। যদিও এই কম্পানি বা তাদের প্রস্তাবিত সরবরাহকারীর আগে বাংলাদেশের কোনো বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় বা নিজ দেশসহ বিশ্বের কোথাও কোনো বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থায় দরপত্রে চাহিদাকৃত ১১ কেভি এসিআর সরবরাহের অভিজ্ঞতা নেই।

তার পরও সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন কমিটি তাদের প্রস্তাবিত পণ্যের কার্যকারিতা যাচাই-বাছাই না করে এসিআরের কন্ট্রোল প্যানেলের টেস্ট রিপোর্ট একই মডেলের না হওয়া সত্ত্বেও অনভিজ্ঞ এসিআর উৎপাদনকারী ও সার্ভিস প্রদানকারী দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। অথচ একই কম্পানিকে ৩৩ কেভি এসিআর সরবরাহকাজে ৭১৩ নম্বর বোর্ডসভায় কারিগরিভাবে নন-রেসপন্সিভ করা হয়েছে।

যদিও দরপত্রে আইটিটি-১৫.১(সি) নম্বর শর্তে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, উৎপাদনকারীর ন্যূনতম এক বছরের দরপত্রে আহবানকৃত মালের সন্তোষজনক অপারেশনের অভিজ্ঞতা সনদপত্র পৃথিবীর যেকোনো বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা থেকে দিতে হবে। কিন্তু দরপত্রে গুণগত মালপত্র ক্রয় নিশ্চিত করার এই শর্তটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দরপত্রে ১২০টি ১১ কেভি এসিআর ক্রয়ের জন্য আহবান করা হয়েছে, অথচ ওই কোরিয়ান কম্পানির ৯ বছরের উৎপাদন মেয়াদে এত এসিআর বানানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দরদাতা প্রতিষ্ঠান-এমআরবিআর করপোরেশনের মালিক রাশেদুল হাসান বিআরইবিতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় চাকরিতে ছিলেন না। চলতি জুলাই মাসে পুনরায় বিআরইবির সহকারী পরিচালক (অর্থ) পদে যোগ দিয়েছেন। এই পরিচিতি ব্যবহার করে তাঁর কম্পানির অসামঞ্জস্যতা ঢেকে সক্রিয়ভাবে কার্যাদেশপ্রাপ্তির জন্য তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং প্রধান প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাশেদুল হাসান আমাদের প্রতিষ্ঠানে কয়েক দিন আগে যোগদান করেছেন। তিনি দীর্ঘ সাত বছরের মতো আরইবিতে ছিলেন না। যেহেতু দীর্ঘদিন আরইবির লোক ছিলেন না, তখন তিনি কম্পানি খুলে ব্যবসাসহ যা খুশি তা করতে পারেন। এখন যেহেতু তিনি পুনরায় আরইবিতে যোগদান করেছেন, বিষয়টি আমাদের প্রতিষ্ঠান বুঝবে।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) আরমান আহসান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, “সহকারী পরিচালক (অর্থ) রাশেদুল হাসান ‘এমআরবিআর করপোরেশন’ বাতিল করে আরইবিতে যোগদান করেছেন।” তিনি বলেন, ‘এসিআর ক্রয়ের দরপত্রটি এখনো চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হয়নি। দরপত্রটি অনুমোদের জন্য গত সোমবার (২৮ জুলাই) বোর্ডে ওঠার কথা ছিল; কিন্তু বোর্ডসভা বাতিল হয়েছে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানের জন্য মালামাল কেনা হবে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কখনোই দরপত্রে অংশ নেওয়ার কাজটি করতে পারেন না। এটি স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার অপব্যবহার ও যোগসাজশে দুর্নীতি। বোর্ডসভা বাতিল করার বিষয়টি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত অনুসন্ধান করে জবাব দিতে হবে এবং তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। যেহেতু তিনি এককভাবে এটি করছেন না, তার সঙ্গে আরো যোগসাজশ আছে। যারা জড়িত, তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এগুলো একসময় একটা চর্চা হয়ে গিয়েছিল, বর্তমান পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে কখনো এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি বোর্ডের যেমন দায়িত্ব, সরকারেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত। সরকার যেন এ ধরনের বিষয়গুলো প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বিদ্যুৎ বিতরণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এসিআর ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত অনুসারে কোনো বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থায় সরবরাহকৃত একই ভোল্টেজ লেভেলের এসিআরের ন্যূনতম দুই থেকে পাঁচ বছরের সন্তোষজনক অপারেশনের অভিজ্ঞতার সনদপত্র (পারফরম্যান্স সার্টিফিকেট) দাখিল করতে হয়। অথচ বিআরইবির দরপত্রে এক বছরের সন্তোষজনক অপারেশনের অভিজ্ঞতার সনদপত্র দাখিলের শর্ত থাকার কারণে যেকোনো অভিজ্ঞতাহীন দরদাতা বা উৎপাদনকারী খুব সহজেই নিম্নমানের এসিআর সরবরাহের সুযোগ পায়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দরদাতা প্রতিষ্ঠানটি তাদের দরপত্রের সঙ্গে যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে, তাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের আয় দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা, যা আয়কর বিভাগের একজন উপকর কমিশনার কর্তৃক প্রত্যয়নও পেয়েছে। কিন্তু হাফিজ আহমেদ অ্যান্ড কোং কর্তৃক জারি করা অডিট রিপোর্ট অনুসারে, গত বছরের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের আয় ছিল এক কোটি ২০ লাখ ১১ হাজার ৩২৯ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে বড় অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়ে কার্যত রাষ্ট্রীয় রাজস্ব হরণ করেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা শুধু দুর্নীতির ইঙ্গিতই দেয় না; বরং সরকারি ক্রয়নীতির আইনি শর্তাবলির সরাসরি লঙ্ঘনও। এর আগে বিআরইবি এ ধরনের জাল কাগজপত্রাদির জন্য সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু এই দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিআরইবি সম্পূর্ণ ঘটনাটি লুকিয়ে গিয়েছিল।

এ বিষয়ে এমআরবিআর করপোরেশনের ম্যানেজার জাহিদুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কম্পানির মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমান মালিক হাসানুজ্জামান। দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্টের নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের ডকুমেন্টসহ কাগজপত্র আমরা জমা দিয়েছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এর আগে বিআরইবি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চার্ডন কোরিয়া কম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ৫২৭টি এসিআর কেনে, যেগুলোর প্রায় সব কটিই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিকল হয়ে যায়। বিআরইবি শিংসুং কোরিয়া থেকেও ৩৯০টি নিম্নমানের এসিআর কিনেছিল। এসব এসিআর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে এসিআর ক্রয়ের সময়ে বিআরইবি ২৭ কেভি এসিআর সরবরাহের অভিজ্ঞতা দেখে কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু ১১ কেভি এসিআর সরবরাহের অভিজ্ঞতা না থাকায় পরবর্তী সময়ে তাদের সরবরাহ করা এসিআর মাঠ পর্যায়ে কোনো কাজে আসেনি। ওই এসিআর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।