Image description
বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তি

ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির বিভেদের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফিরে আসতে চায়। এজন্য গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় এসে সরকার ও রাষ্ট্রকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে মরিয়া। এ বিষয়ে একাধিক মাস্টার প্ল্যান নিয়ে দলটির মাফিয়াচক্র গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যাদের বিপুলসংখ্যক সদস্য দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থান করছে। তাদের হিট অ্যান্ড রান গ্রুপ ইতোমধ্যে সন্ত্রাসী হামলার প্রশিক্ষণও নিয়েছে। ছয় মাস ধরে তারা বিভিন্নভাবে তাদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন আগস্টকে টার্গেট করে মরণকামড় দিতে তারা ভয়ংকর সব পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বয়ং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। সহযোগী হিসাবে রয়েছে তার আস্থাভাজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় টপলিস্ট ক্যাডারদের একটি কোর গ্রুপ। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে থাকা তাদের দোসররাও মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে একযোগে সক্রিয় হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে এমন সব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এদিকে ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগের এ ধরনের নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে সারা দেশে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, রহস্যজনক কারণে এসব চক্রান্তের বিষয়ে সরকার সময়মতো যথাযথ গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাচ্ছে না। যে কারণে আগাম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এছাড়া প্রকৃত তথ্যের চেয়ে মহলবিশেষ নানারকম প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিয়ে জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টাও করছে। এটাও ফ্যাসিবাদী চক্রের মাস্টার প্ল্যানের অংশ।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিক ও বিশ্লেষক যুগান্তরকে জানান, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগকে হটাতে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে যারা রাজপথে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তাদের প্রত্যেককে এখন একইভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ভোটের মাঠে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, ফ্যাসিস্ট হটাও ইস্যুতে সত্যিকরার্থে ঐক্যবদ্ধ না থাকলে সবাইকে বড় বিপদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে বৈকি। তারা এও বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে ইতোমধ্যে সফল হয়ে গেছে। ৬-৭ মাস ধরে সবাই এ ফাঁদে পা দিয়েছে। এর ফলে গত জুলাইয়ে যারা ছিলেন পরস্পরের মিত্র, তারা এখন একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি কথা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলসহ রাজনীতিকরা মনে হয় ভুলেই গেছেন। সেটি হলো-প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সর্বস্তরে তাদের লোকজন প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা কি তাদের ঠিকঠাক চিহ্নিত করে অপসারণ করতে পেরেছি? নিশ্চয় পারিনি। ফলে শত্রুর দোসরদের সঙ্গে রেখে শক্র মোকাবিলা যে কখনো সম্ভব নয়, সেটি আরেকবার প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। মূলত ফ্যাসিবাদী শক্তিকে সমূলে প্রতিহত করতে যেভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, এর অনেক কিছুই হয়নি। এতে বিদ্যমান মাঠ শত্রুপক্ষের জন্য খুবই উর্বর বললে ভুল বলা হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার সভাপতি কর্নেল (অব.) আব্দুল হক যুগান্তরকে বলেন, হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনামলটা ছিল বাংলাদেশের মূল ভিত্তিকে নষ্ট করে দেওয়া। এটা ছিল খুবই সুপরিকল্পিত এবং প্রতিবেশী দেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। তারা ইসলামি আদর্শকে চিরতরে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল। হাসিনা তার শাসনামলে অবৈধ দখলদারি কায়েম করেছিল, যার ফলাফল হিসাবে জনগণ অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ও অবৈধ সরকারের চরম দুঃশাসন ভোগ করেছে। ভারতের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তারা কাজগুলো করেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘এখন এ পরিস্থিতিতে যখন আমাদের দেশ মুক্ত হলো, তখনো কিন্তু বিভিন্ন সেক্টরে তাদের এলিমেন্ট রয়ে গেছে। অথচ সেভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কিংবা অ্যাকশন নেওয়া হয়নি। এটা সরকারের ব্যর্থতা। এর সুযোগ নিয়ে তারা ফের নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তারা গোপালগঞ্জে জানান দিল-হ্যাঁ, আমরা এখনো আছি। এছাড়া সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে আক্রমণ করাকে আপনি কি ইগনোর করতে পারেন? প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়। ফলে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট বাস্তবিকই সত্য। তারা ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে। এ পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দেশ জড়িত। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারাই আশকারা দিচ্ছে।’

এ পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টাকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল এবং সব পেশাজীবীর সঙ্গে বৈঠক করার পরামর্শ দিয়ে কর্নেল (অব.) আব্দুল হক আরও বলেন, ‘ড. ইউনূস সর্বদলীয় মিটিং ডাকবেন। শুধু দলীয় বা রাজনৈতিক দল না, পেশাজীবীদেরও ডাকতে হবে। প্রতিটি পেশাজীবী সংগঠনকে ইনক্লুডিং আর্মি, ইনক্লুডিং আমাদের রাওয়া।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশে নৈরাজ্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আমরা এখনো এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। যেহেতু পুলিশ ও সরকারপক্ষ এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তাই ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জনগণকেও সাবধান থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যেসব রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসবিরোধী ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ধারণা রাখে, তারা তো কেউই এটাকে পছন্দ করতে পারে না। অতএব যারা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তাদের প্রতিহত করতে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় দলগুলো সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। আর সরকারেরও উচিত হবে শক্তভাবে নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা। এদের প্রতিহত করতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জায়গায় কিছু ঘটনা ঘটেছে। কখনো কখনো আওয়ামী লীগ স্বনামে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, আবার বেনামেও করছে। সচিবালয়ে আন্দোলনকারী পরিচয়ে ঢুকে সহিংসতার চেষ্টা করেছে। তারা তো ফ্যাসিস্ট হিসাবে দীর্ঘ ১৫ বছর সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। এখন পালানোর পরও তারা একই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সে হিসাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১১ দিনের যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, সরকারের কাছে অবশ্যই গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে। আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে অতীতের ঘটনাগুলো যেভাবে মোকাবিলা করেছি, আগামী দিনেও এ জায়গায় ঐক্যবদ্ধ আছি, থাকব। এই অঙ্গীকার আমাদের আছে। কারণ, দেশকে আবারও সেই আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া কিংবা সেই অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, দেশের যে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তা মোকাবিলার দায়িত্ব প্রথমত সরকারের এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রশাসনের। বর্তমানে দেশ যে পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ও জনগণ কোনো বিশৃঙ্খলা মেনে নেবে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক ফ্যসিবাদবিরোধী শক্তি, ছাত্রসমাজ, জনসাধারণ-সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে যে কোনো ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ১১ দিনের সতর্কতা নিয়ে সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি কোনো না কোনো চেহারায় তারা ফিরতে চায়। তারা একটা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে অস্থিতিশীলতা বাড়াতে চায়। ফলে এটা শুধু ১১ দিনের প্রশ্ন না। এক বছর ধরেই তারা কিন্তু বহুমাত্রিকভাবে একটা অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এখন আবার নানাভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ খুঁজছে। গোপালগঞ্জের ঘটনা বা কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের সচিবালয় অভিমুখে আন্দোলন, সেখানেও আমরা দেখেছি অনেকেই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চেয়েছে। যেটাকে বলে অনেকটা ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেওয়া আর কী।

তিনি আরও বলেন, যারা অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিল, তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও সতর্কতা এ পর্যন্ত অভ্যুত্থানকে রক্ষা করেই এসেছে। ফলে সরকারের শুধু ১১ দিনের এই সতর্কতা দিয়ে কোনো কিছু করা যাবে বলে আমি মনে করি না। দরকার হচ্ছে জনসচেতনতা। এক ধরনের জেগে থাকা। মানে ওই অর্থে জেগে থাকা যে, আমাদের অভ্যুত্থানের অর্জন যেন বিসর্জন হয়ে না যায়। সেই ভূমিকাটা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু অভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একই সঙ্গে সিভিল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সিরিয়াসলি বার্তাটা দিতে হবে।