Image description
 

উদ্দেশ্য ছিল অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করা। বৈধভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও মুদ্রা বৈচিত্র্যসহ আমদানি-রফতানিতে স্বচ্ছতার সঙ্গে অর্থায়ন করা। যে কারণে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও অফশোর ব্যাংকিংয়ে কর সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিগত দিনে দেখা গেছে, সরকারের বৈধ উদ্দেশ্যের বিপরীতে অসাধু ব্যবসায়ীরা অর্থপাচার, কর ফাঁকি ও অবৈধ আয়ের উৎস গোপন রেখে দুর্নীতির বিপুল পরিমাণ অর্থ আড়াল করেছেন।

এছাড়া আমদানি-রফতানির আড়ালে শেল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও টাকা পাচারে সক্রিয় রয়েছে অর্থ পাচারকারীরা। পাচারের এসব রুট ও পাচারকারীদের নিত্যনতুন কৌশলের কাছে হিমশিম খাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) আর্থিক অপরাধ নিয়ে কাজ করা সরকারের অন্যান্য সংস্থাও। বিএফআই্‌ইউ থেকে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোকে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও দেশ থেকে নানা উপায়ে অর্থ পাচার হচ্ছে।

অর্থপাচার প্রতিরোধে সরকারের আরও যেসব সংস্থা কাজ করে—সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর, মাদকদ্রব্য অধিদফতর ও পরিবেশ অধিদফতর। দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও বিএফইউ ছাড়া অন্য সংস্থাগুলোর এখন পর্যন্ত তেমন একটা কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। যদিও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে এটিকে দন্তহীন একটি সংস্থায় পরিণত করে রাখা হয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর বিধান অনুযায়ী, ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাত্র একটির। ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অর্জিত অর্থের মানি লন্ডারিং তদন্তের জন্যই কেবল তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা বা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছে— বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। অথচ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচারের অনুসন্ধান, কিংবা তদন্তের দায়িত্ব দুদকের নেই। এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। তবে এ দুটি সংস্থা পাচার ঠেকানো কিংবা পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে পেরেছে—এমন তথ্য কারও জানা নেই। দুদক কেবল ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার হলে আইন অনুযায়ী সেটাই তদন্ত করতে পারে। তবে তারা আদালতের আদেশ নিয়ে কিছু কিছু কাজ করে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আয়কর কর্তৃপক্ষের আওতার বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজার-হাজার কোটি ডলার রাখা আছে। আর পাচারকারীরা এই মাধ্যম ব্যবহারে নানা কৌশল নিয়ে থাকে। তাছাড়া প্রকৃত মালিকের নাম ছাড়াই অর্থের বিনিময়ে নমিনি বা প্রতিনিধি নিয়োগ করে অফশোর কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। পৃথিবীর কিছু ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রেও শূন্য আয়করের সুবিধা আছে, যেখানে পাচারকারীরা বিনিয়োগের নামে অর্থ লুকিয়ে রাখে।

 

অপরদিকে শেল ব্যাংকিংকে মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচারের ক্ষেত্রে নতুন আপদ বলে মনে করেন দুদক কর্মকর্তারা। অস্তিত্বহীন এই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার হলে তার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু এটুকু বুঝতে পারা যায়— কোনও কোম্পানি পণ্য রফতানি করেছে। কিন্তু সেই টাকা আর দেশে ফেরত আসেনি। আর এতেই তারা বুঝে নেন যে ওই টাকা পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ’র তদন্তেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে বিএফআইইউ’র তদন্তে শেল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারের বিষয়টি ধরা পড়ে। যে কারণে ২০২০ সালের ১৬ জুন এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়নের ঝুঁকি প্রতিরোধে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়—শেল ব্যাংকের সঙ্গে কোনও ধরনের ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। এই বিষয়টি বিএফআইউ নিয়মিত তদারকি করবে।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা ও কিছু আইনি জটিলতা থাকার পরও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সহযোগিতা নিয়ে দুদক কাজ করে যাচ্ছে।’

সর্বশেষ গত ৩ জুলাই (২০২৫) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ সার্কুলার বা বৈদেশিক মুদ্রা বিষয়ক একটি সার্কুলার জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে রাখা বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল জামানত হিসেবে ব্যবহার করে—দেশে কার্যরত কোম্পানি ও ব্যক্তি পর্যায়ে প্রচলিত ব্যাংকগুলো এখন থেকে টাকায় ঋণ দিতে পারবে। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিরাও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে তাদের জমা করা বৈদেশিক মুদ্রা জামানত হিসেবে রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন।

অফশোর ব্যাংকিংয়ে নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী নন রেসিডেন্ট বা অনিবাসী হিসাবধারীদের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে (ওবিইউ) রাখা বৈদেশিক মুদ্রা ডোমেস্টিক ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে টাকায় ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জামানত হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক, বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় অফশোরে আমানত রাখতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, ওবিইউ ছাড়াও প্রাইভেট ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট ও নন-রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে থাকা ব্যালান্সও জামানত হিসেবে ব্যবহার করে টাকায় ঋণ নেওয়া যাবে। তবে ওবিইউ’র মাধ্যমে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, নতুন নিয়মে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে।

অর্থপাচারের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ বাড়ছে।’ তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সম্পদ জব্দের ঘটনা সে চাপেরই অংশ বলে মনে করেন তিনি।

গভর্নর বলেন, ‘লন্ডনে সম্পদ জব্দের ঘটনাটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। এই ধারা অব্যাহত রেখে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাচার করা সম্পদ চিহ্নিত ও জব্দ করা সম্ভব হবে।’

ড. আহসান মনসুর আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এই অর্থ দেশে আনতে অনেক সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘সম্পদ জব্দ করা গেলেও তা দেশে ফেরাতে অন্তত ৪ থেকে ৫ বছর লেগে যেতে পারে। তবে এক বছরের মধ্যেই বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করা সম্ভব। এছাড়া পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কূটনৈতিক তৎপরতা ও আইনগত প্রস্তুতি একযোগে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’