
‘মাছবাজারে গিয়ে দাঁড়ালেই বুক ধড়ফড় করে। ছেলেটা মাছ ভালোবাসে, কিন্তু এখন তো বাজারে গেলে ভাবতে হয়, মাছ কিনব না চাল আনব।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকার বাসিন্দা রুবিনা বেগম। তিনি একটি পোশাক কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তার স্বামী দারোয়ান হিসেবে কাজ করেন স্থানীয় একটি স্কুলে। দুজনের সামান্য আয়ে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে চলেন। সংসারের খরচ, বাড়িভাড়া আর সন্তানের স্কুলের খরচ মেলাতে গিয়ে তিনি এখন প্রায়ই প্রতি মাসেই দেনায় পড়ছেন।
রুবিনার মতো অভিজ্ঞতা দেশের লাখো নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির চাপে অনেকেই দিশাহারা। আয় বাড়েনি, অথচ খরচ বেড়েছে বহুগুণ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী শ্রেণিও পড়েছে টিকে থাকার লড়াইয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পকেটের ওপর এ চাপ শুধু আর্থিক নয়, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতার দিকেও হুমকি। মানুষ যখন ন্যূনতম প্রয়োজনেই হোঁচট খায়, তখন সমাজে ক্ষোভ, হতাশা ও অনাস্থা বাড়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটি নীরব ক্ষোভ জমছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান শুধু দাম কমানোতে নয়, আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থাও জরুরি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। পণ্যের দাম বাড়লেও, আয় একইভাবে বাড়ছে না, যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। বিশেষত নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য এ পরিস্থিতি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। পণ্যের দাম বাড়লেও আয় একইভাবে বাড়ছে না, ফলে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠছে
ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
সবচেয়ে বেশি ব্যয় খাবারে; পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, মাসিক খরচের ক্ষেত্রে, মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় খাবারে। তাদের বিশ্লেষণে, চলতি বছরের জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ৫০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভূমিকা রেখেছে চালের দাম বৃদ্ধি। আর ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভূমিকা মাছের দাম বৃদ্ধিতে। তাছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ অবদান ফলের বাজারের, ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ তেল কেনায়, ২ দশমিক ৬ শতাংশ দুধ কেনায় এবং শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ মাংস কেনায়। ইলিশ মাছ, বেগুন, সয়াবিন তেল এবং টম্যাটোসহ অন্য পণ্যগুলো উচ্চ মূল্যবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
পরিসংখ্যান ও বাস্তব চিত্র; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা মে মাসে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ বিবিএসের তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে। কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। চাল, ডাল, তেল, ডিম, দুধ, আলু-প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামই গত এক বছরে বেড়েছে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু বিপরীতে মানুষের আয় বেড়েছে নামমাত্র বা আদৌ বাড়েনি।
মধ্যবিত্তের সংকট : না বলার সাহস নেই, কষ্ট বলার জায়গাও নেই; ঢাকার মিরপুর এলাকার বাসিন্দা শামসুল আলম। কাজ করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। মাসে আয় ৩২ হাজার টাকা। তার স্ত্রী গৃহিণী, দুটি সন্তান পড়ে স্কুলে। ‘বাচ্চাদের স্কুল ফি, বাসাভাড়া, খাবার, বিদ্যুৎ বিল সব কিছু মিলে মাসের ২০ তারিখের পর টাকা থাকে না। ঈদে জামাকাপড় কিনে দিতে গেলে মনে হয় নিজে না খেয়ে থাকি, তবেই পারব,’ বললেন তিনি। একই কষ্টের কথা বললেন রিকশাচালক মিজানুর রহমান। একসময় দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হতো। এখন তেলের দাম, সার্ভিস খরচ ও যাত্রীর ভাড়া না বাড়ায় আয় কমেছে। অথচ চাল-ডাল কিনতেই দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সিপিডি সম্প্রতি এক গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে দারিদ্র্যপীড়িত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখন সঞ্চয়হীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সমস্যা অনুভব করছে, কারণ উচ্চমূল্যে খাদ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে।’ তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি শুধু আর্থিক অসুবিধার সৃষ্টি করে না, বরং এটি সামাজিক সমস্যাও তৈরি করে। যারা দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত, তারা এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করছেন। প্রায় তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে সমাজের বৃহত্তর অংশের জন্য জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে।’
সিপিডি বলছে, শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর ৬৫ শতাংশই মাস শেষে ধারকর্জে পড়ছে। সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই। প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত-সব খরচই সীমিত করে ফেলেছে পরিবারগুলো।