Image description

দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ গোছাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে— সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ রাখায় ভূমিকা রাখতে পারে এমন চৌকস ও দক্ষ কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে নেতিবাচক রাজনৈতিক তকমা রয়েছে কিংবা অতীতে অতি-উৎসাহী হয়ে বিতর্কিত কমিশনের সব কাজে সায় দিয়েছিলেন এমন দলবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এরই আলোকে গত রোববার থানা বা উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলির মাধ্যমে শুরু হয়েছে ইসির দৃশ্যমান অ্যাকশন। এ দিন ৭১ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ওই নির্বাচনে অনিয়মের দায়ে আটক কে এম হাবিবুল আউয়ালের কমিশনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব কর্মকর্তা সহযোগী হয়ে কাজ করেছিলেন। এসব কর্মকর্তার মধ্যে একজন হলেন— উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তালুকদার। এই কর্মকর্তাকে শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় বদলি করা হয়। একইভাবে, সিলেটের গোলাপগঞ্জের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আহসান ইকবালকে বিয়ানীবাজার উপজেলায় বদলি করা হয়েছে। বদলি করা সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইসির অবস্থান অভিন্ন।

এ প্রসঙ্গে ইসির একজন যুগ্মসচিব রোববার রাতে আমার দেশকে জানান, যাদের বদলি করা হয়েছে সবাই দ্বাদশ সংসদে ওই কর্মস্থলেই দায়িত্ব পালন করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ধাপে সারাদেশের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, তৃতীয় ধাপে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই) এবং চতুর্থ ধাপে খোদ সচিবালয়ের মধ্যে কর্মরত (শুধু ডেস্ক বদল হয়েছে), বিগত কমিশনের একান্ত সচিব (পিএস) ও তাদের সহায়ক হয়ে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি করা হতে পারে।

ইসির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বর্তমান এ এম নাসির উদ্দিন কমিশন কোনো কর্মকর্তার অনিয়মের দায় নেবে না এ ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চায়। তাদের দায়বদ্ধতা জনগণ ও ভোটারদের কাছে এমনটাই তারা জানিয়েছেন। ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারলেই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক ঐক্যও এক্ষেত্রে সমান ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে ইসি। এ কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রভাবশালী কোনো দলকে ছাড় দিতে নারাজ। এমনকি এসব দলের অনুগত ইসির কোনো কর্মকর্তা তাদের পক্ষ হয়ে কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্তকে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে আগামী নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে কর্মহীন বা নিষ্ক্রিয় রাখার চিন্তা রয়েছে।

একাধিক নির্বাচন কমিশনার তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। তবে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা, বিভিন্ন সোর্স বা নিজ উৎস থেকে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কারো প্রতি বিরাগভাজন হয়ে কিংবা যৌক্তিক কারণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে পুরো কমিশনের সিদ্ধান্ত অগ্রাধিকার পাবে। নির্বাচনের আগে যাকেই বদলি করা হোক ইসির সিদ্ধান্ত মানতে হবে। সম্প্রতি ঢাকার একজন থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে দূরে বদলি করা হয়। তিনি বদলি ঠেকাতে কমিশনের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বিশেষ মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ইসি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। আরেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার (আরইও) ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে এই আরইওকে বদলির কয়েক দিনের মাথায় প্রত্যাহার করায় ইসির ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে।

গত বছরের ২১ নভেম্বর এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনকে নিয়োগ দেয় সরকার। গত আট মাস ধরে প্রতিটি কর্মযজ্ঞের সঙ্গে নিজেদের নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত রাখা এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেছে এই কমিশন। ইতিমধ্যে নির্বাচনের প্রধান প্রধান কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ভোটার তালিকা সম্পন্ন হওয়া, ৪৫ হাজার ভোট কেন্দ্র ‍চূড়ান্ত, নির্বাচন পর্যবেক্ষক (দেশি-বিদেশি) সংস্থা, গণমাধ্যম নীতিমালা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। প্রবাসীদের প্রতীকী হলেও ভোটদানের ব্যবস্থা করতে কার্যক্রম অনেক এগিয়েছে বলেও জানা যায়।

শুধু ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের কারণে আরপিও সংস্কার ও সংসদীয় আসনের সীমানা বিন্যাসের কাজটি চলমান রয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এটির খসড়া প্রকাশ করা হতে পারে। আর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানি করা নির্বাচনি মালামাল পাচ্ছে ইসি। এর ফলে এ পর্যায়ের কাজটিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শুধু নির্বাচনি মাঠ গোছানোর কাজটিতে পিছিয়ে ছিল; সেটির দিকে এখন নজর ইসির।

এদিকে, আগস্টের ৩ তারিখের মধ্যে জুলাই সনদ এবং ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ত্রয়োদশ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ঘিরে যে দোলাচল ছিল তা অনেকাংশে দূর হবে বলে মনে করছে ইসির কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে দেশে নির্বাচনমুখী আবহ তৈরি হওয়ায় দল নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নির্বাচনি মাঠ গোছাতে অ্যাকশনে নেমেছে কমিশন। কয়েকদিন আগে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা পর্যায়ে ছোট পরিসরে বদলি করা হয়। রোববার থানা-উপজেলা পর্যায়ে প্রায় একশজনকে বদলি করা হয়েছে। এবার ইটিআই ও সচিবালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত কর্মকর্তাদের বদলি করার চিন্তা করা হচ্ছে। তবে বিগত তিনটি কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত দু-একজন কর্মকর্তা বর্তমান ইসির অনুকম্পা পেতে পারেন। কারণ তারা ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে কাজ করলেও জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক শক্তিদের সহায়তা করেছিলেন এমন খবরও চাউর রয়েছে ইসিতে। গত আট মাসে তাদের ভাগ্য খোলেনি। উল্টো কোণঠাসা তারা।

তারা আরো জানান, জনসমর্থন রয়েছে এমন রাজনৈতিক দলের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখছে কমিশন। অতি-উৎসাহী কর্মকর্তার কারণে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া বিতর্কিত যেন না হয়, কিংবা রাজনৈতিক তকমা কমিশনারদের শরীরে লাগতে না পারে সেটিও সতর্কতার সঙ্গে দেখছে নীতি-নির্ধারকরা।

আবার এতদিন সচিবালয়ের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন যোগ্য কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করা হবে বলেও বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাছাড়া ইসির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এ কর্মকাণ্ডে বিব্রত ইসি। তাদের বিষয়ে ইসি সচিবালয় ও কমিশনারদের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’।