Image description

বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় মেডিকেল ভিসায় আসা শেখ জলিল বলছিলেন, বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের বর্তমান অবস্থা দেখে কান্না পেয়েছে। নেই আগের সেই ব্যস্ততা। শ্রমিক থেকে দোকানদার, মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রগুলোতে নেই কোনও কাজ। সবাই হা-হুতাশ করে দিন কাটাচ্ছেন।

 

পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যে পেট্রাপোল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হতো তার ৩০ শতাংশ এই স্থল বন্দর দিয়েই হতো। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়েনের পরিণতিতে। তবে গত মে মাসে ভারত সরকারের স্থল বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানির উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপের ফলে গত তিন মাসে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সীমান্ত নির্ভর মানুষের জীবন-জীবিকা একরকম স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষ এবং পণ্যের স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। 

ভারত সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফল ভিত্তিক পানীয়, প্লাস্টিক এবং পিভিসি তৈরি পণ্য (কাঁচামাল বাদে), সুতির বর্জ্য এবং কাঠের আসবাবপত্রের মতো বিভিন্ন পণ্য আমদানি স্থল বন্দর দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আমদানি-রফতানির সঙ্গে যুক্ত এক ব্যবসায়ী জানালেন, শুধু পেট্রাপোল বন্দর নয়, পশ্চিমবঙ্গের ঘোজাডাঙ্গা, হিলি, চ্যাংরাবান্ধা, ফুলবাড়ি ও মহদিপুর সীমান্তের পরিস্থিতিও খুবই উদ্বেগজনক।

সীমান্ত বাণিজ্য ও যাত্রী চলাচলের উপর নির্ভরশীল লক্ষাধিক মানুষ রুজি হারিয়ে প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছন। কেউ চায়ের দোকান খুলেছেন, কেউ রাস্তায় সবজি বিক্রি করছেন আবার অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঘরে বসে রয়েছেন। 

পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তীর সঙ্গে পেট্রাপোলের পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি হতাশার সুরে বলেন, এক কথায় বলতে গেলে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। বাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তা নিয়েই সকলে চিন্তিত। নানা শঙ্কায় ব্যবসা বাণিজ্য যতটুকু চলছিল তাও কমতে শুরু করেছে বলে তিনি জানান।

স্থানীয় এক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা জানান, পেট্রাপোল থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০-২৫০টি রফতানি পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও আমদানি করা ট্রাকের সংখ্যা কমে মাত্র ৩০-৪০টিতে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন না। 

কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ট্রান্সপোর্টাররা। কয়েক হাজার চালক ও তার সহকারী কাজ হারিয়েছেন। এছাড়া, মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, খাবারের দোকান থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজে যুক্ত মানুষ রুজি হারিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। যাত্রী আসা-যাওয়া একরকম নেই বললেই চলে। মেডিকেল ভিসায় যে বাংলাদেশিরা আসছেন তাদের সংখ্যাও খুবই সামান্য। 

তিনি বলেন, সীমান্তে অন্য কোনও ব্যবসা করার সুযোগ নেই। সবটাই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও যাত্রীর উপর নির্ভরশীল। তাই বুঝতেই পারছেন, পরিস্থিতি কতটা সংকটজনক। 

এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পেট্রাপোল বন্দরের কয়েক হাজার শ্রমিক পেট্রাপোল স্থলবন্দরে একটি যৌথ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক এক সময় পেট্রাপোলের লোডিং ও আনলোডিংয়ের কাজে যুক্ত ছিলেন। 

শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, ভারত সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধের ফলে দৈনিক উপার্জন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা তাদের মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
রাজনৈতিক সীমারেখা ছাড়িয়ে ৫টি ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারত সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে- স্বাভাবিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি এই বাণিজ্য পথের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীলদের আয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে পেট্রাপোল বন্দরের সঙ্গে যুক্ত কার্যক্রম থেকে জীবিকা নির্বাহকারী এক লাখেরও বেশি মানুষের দুর্দশার কথাও তুলে ধরেছেন তারা।

বিএমএস-এর বনগাঁও ইউনিটের সভাপতি অরুণাভ পোদ্দার অভিযোগ করেন, শ্রমিকরা এখন প্রায় অনাহারে রয়েছেন।  তিনি দাবি করেন, যে শ্রমিক কয়েক মাস আগেও মাসে ২০ হাজার রুপি উপার্জন করতেন, তিনি ৫ হাজার রুপিও উপার্জন করতে পারছেন না।

সিটু নেতা বাপি সিকদার স্থানীয় অর্থনীতিতে বন্দরের ভূমিকাকে দুর্বল করার জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, সরকার এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পেট্রাপোল বন্দরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।