Image description

জুলাই গণহত্যার মাস। এ মাসের প্রসঙ্গ এলেই মনে ভেসে ওঠে ভয়াবহ সেই ৩৬ দিন। ক্যালেন্ডারের পাতাও সে নির্মমতার কথাই জানান দিচ্ছে। এ কারণে শহীদদের মায়েদের নীরব কান্নার মাস জুলাই। সন্তানের শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। এখনো নির্মমতার বিচারও দৃশ্যমান হয়নি, যা শহীদ পরিবারগুলোর শোক আরো বাড়িয়ে দেয়। ২০২৪-এর শহীদদের পরিবারগুলোর বর্ণনায় এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

শহীদ আহনাফ আহমেদের মা জারতাজ পারভীন বলেন, ‘একটা সন্তানকে জন্ম থেকে ১৬-১৭ বছর লালনপালন করতে গিয়ে আমাদের মায়েদের কত কিছু যে ত্যাগ করতে হয়েছে। আর সেই কষ্টের সন্তানকে এ স্বৈরাচাররা কোনো দোষ ছাড়াই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করল।’ তিনি বলেন, ‘আহনাফ আমার কলিজার টুকরা ছেলে ছিল। ওকে ছাড়া আমি একটা মুহূর্ত থাকতে পারতাম না। আর আজ একটা বছর হতে চলছে আমার আহনাফ আমার কাছে নাই।’

‘আল্লাহ আমাকে এখনো কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন’Ñবলতে বলতেই অঝোরে কান্না শুরু করেন তিনি।

গত বছরের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মিরপুর ১০-এ স্বৈরাচারের দোসরদের গুলিতে শহীদ হন আহনাফ। ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ছিল সে। ২০২৫-এর এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল আহনাফ। মা জারতাজ পারভীন বলেন, ‘আমার ছেলের অনেক স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। নিজের একটা মিউজিক ব্যান্ড খুলবে। কারণ আহনাফ গিটার বাজাতে অনেক ভালোবাসত। গিটার আর ফুটবল ছিল তার জীবন। আমার বাচ্চাটার সব স্বপ্ন শেষ করে দিল স্বৈরাচার-খুনি হাসিনা ও তার দোসররা।’

এখনো জুলাই গণহত্যার বিচার না হওয়ায় আক্ষেপ করে পারভীন আরো বলেন, ‘আজ একটা বছর হতে চলছে আমাদের সন্তানদের হত্যার বিচারের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের যে শেষ ঠিকানা সেটাও এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। আমরা এত অপদার্থ মা যে, সন্তানকে যারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করল তাদের কোনো বিচার করতে পারছি না।’

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে আনুমানিক দুপুর ১টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় জাহিদুজ্জামান তানভীন। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার ভিটি ভিশারা গ্রামে। ড্রোন নিয়ে কাজ করতেন। স্বপ্ন ছিল দেশে ড্রোনবিষয়ক সার্ভিসগুলো বাস্তবায়ন করবেন।

মা বিলকিস জামান বলেন, ‘পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়েছিল। গুলি করে আমার ছেলের বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল মানুষরূপী হিংস্র পশুগুলো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, তাহাজ্জুদ পড়ত। মানুষের বিপদে সব সময় ছুটে যেত। বিদেশে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য কাগজপত্রও সব রেডি হয়ে গিয়েছিল। বিদেশে থেকে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে দেশের উন্নয়নে কাজ করার স্বপ্ন দেখত আমার ছেলে।’

এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়া বিলকিস জামান বলেন, ‘আমার ছেলে যে কি রত্ন ছিল, সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। আমার একমাত্র মেধাবী ছেলেকে ওরা কেড়ে নিয়ে আমার পৃথিবীটাকে শেষ করে দিয়েছে। আমি এখন বেঁচে থেকেও মৃত। আমার ও পরিবারের একটাই দাবিÑএ ফ্যাসিবাদের দোসর ও তাদের সহযোগীদের বিচার নিশ্চিত করা। তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশে যেন কোনো নির্বাচন না হয়।’

গত বছরের ১৯ জুলাই উত্তরায় নিজ বাসার বারান্দায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নাঈমা সুলতানা। নাঈমার মা আইনুন নাহার আমার দেশকে বলেন, ‘জুলাই মাস এলেই নাঈমার কথা বেশি বেশি মনে পড়ে। এ মাসেই আমার মেয়েকে হারানো এক বছর পূর্ণ হয়েছে। সব সময় তার শূন্যতা অনুভব করি। এ শূন্যতা আমার কীভাবে পূরণ হবে জানি না।’

আইনুন নাহার বলেন, ‘নাঈমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। ক্লাসে প্রথম ছিল সে। কিন্তু একটি গুলি সব স্বপ্ন ভেঙে দিল। এখন মেয়ের রেখে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আর ওর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। আমার মেধাবী মেয়েকে হারিয়ে আমরা সপরিবার পাথর হয়ে গেছি।’

‘আমি আমার সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই’ উল্লেখ করে নাহার বলেন, ‘আমার একটাই চাওয়া এ দেশে আর যেন জুলাই না আসে। কোনো পরিবার তার প্রিয়জনকে যেন না হারায়। সন্তানদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চাই।’

মোহাম্মদ সাজিদুর রহমান ওমরকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় মা পারভীন আক্তার। প্রাণপ্রিয় ছেলের অকালমৃত্যু, হঠাৎ চলে যাওয়াÑকিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছেন না তিনি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমার ওমরকে ছাড়া মা যে পাগলপাড়া, আমার কলিজার টুকরা সন্তান কি জানে সেটা?’

পারভীন আক্তারের চার সন্তানের মধ্যে ওমর ছিলেন সবার ছোট। এজন্য তার আদরও ছিল বেশি। ২১ বছর বয়সি ওমর প্রচণ্ড রকমের মেধাবী ছিলেন। তার এ মেধার পরিচয় ছোট্ট জীবনে বহুগুণের মাধ্যমে রেখে গেছেন।

গত বছরের ২১ জুলাই ঢাকা-যাত্রাবাড়ী সড়কের কাজলা এলাকায় আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ওমর। তার বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনের সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওমর মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসক সিটি স্ক্যান করে নিশ্চিত হন, গুলিটি তার মাথায় নেই; একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার মাথা থেকে অনবরত ব্লিডিং হচ্ছিল। এভাবেই অজ্ঞান অবস্থায় ২১ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত টানা চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান ওমর। ছেলের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় পুরো পরিবারের স্বপ্নগুলো।

ওমরের ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মা প্রতি রাতে আমার ভাইয়ের জন্য কান্না করেন আর বলেনÑ‘আমার ওমর আমাকে এভাবে অসময়ে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। আমি কোনোদিন সেটা ভাবতেও পারিনি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য আমার আদরের ভাই হারিয়েছি। যাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা পেয়েছি। দেশবাসীর কাছে আমাদের প্রতিটি শহীদ পরিবারের দাবি তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। একই সঙ্গে সরকারের কাছে একজন শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই।’

সিরাজুল ইসলাম জানান, পুলিশের তদন্তে জানানো হয়েছে, ওমরের মাথার গুলিটি ২০০ মিটার দূর থেকে করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের অবস্থান ও পুলিশের অবস্থানের দূরত্ব মাপার পরÑএটিই বোঝা গেছে বলে জানান তারা।

কথা হয় শহীদ খালিদ হোসেন শান্তর পরিবারের সঙ্গে। খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান সে। পরিবারে তার বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। তিনিই পরিবারের সব চাহিদা পূরণের চেষ্টা করতেন। শান্তর স্বপ্ন ছিল সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। তার বাবা-মায়ের দুঃখ দুর্দশা দূর করবে। তার বাবা-মাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দেবে। কিন্তু স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী ও হেলমেট বাহিনী তার স্বপ্ন আর পূরণ করতে দিল না। তার বাবা-মা কান্না করতে করতে বলেন, ‘আমরা কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব, কে আমাদের দেখে রাখবে, কে আমাদের কবরের পাশে গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে?’

আওয়ামী লীগ সরকার গত বছরের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অঘোষিতভাবে যুদ্ধে নেমে পড়ে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, চাইনিজ রাইফেল, ছুরি, চাপাতি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ফ্যাসিবাদের দোসর কিছু কিছু পুলিশ সদস্য। তাদের গুলিতে পথচারী থেকে শুরু করে মায়ের কোলের অবুঝ শিশুÑকেউই রেহাই পায়নি।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, একদফা দাবির আন্দোলনে যশোরে চিত্রার মোড়ে আন্দোলনে অংশ নেন শান্ত। আন্দোলন চলাকালীন একপর্যায়ে হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে কৌতূহলবশত ঢুকে পড়েন শহীদ শান্ত। সেদিন আওয়ামী নরপিশাচরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের সেই ধ্বংসযজ্ঞে ছাই হয় জাবের হোটেলটি। ‘আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাননি হোটেলে অবস্থানরত শান্ত।

একপর্যায়ে ৯ম তলা থেকে নিজের গায়ের জামা হাতে পেঁচিয়ে ওড়াতে থাকেন এবং বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকেন। আন্দোলনকারীরা শান্তকে উদ্ধার করে আনেন ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে আগুনে তার পুরো শরীর পুড়ে যায়। কমপ্লিট শাটডাউন জারি থাকায় শান্তকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন তারা। তারপরও যশোর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। ততক্ষণে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাত বরণ করেন শান্ত।