
বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। মাঝে সময় মাত্র পাঁচ দিন। এর মধ্যে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসাবে যুক্তরাষ্ট্র। এতে তৈরি পোশাক শিল্পসহ দেশের রপ্তানি খাতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে পরিত্রাণের কৌশল হিসেবে সামনে এসেছে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা। চলমান শুল্ক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ উচ্চমূল্যের পণ্য কেনার কৌশল নিচ্ছে। এই ‘স্ট্র্যাটেজিক ডিল’ শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের মন জয়ে একটি কার্যকর ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বোয়িং কেনা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার একটি রাস্তা, তবে তা হতে হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করেই।
বোয়িং কেনার বিনিময়ে শুল্কছাড় আদায় সম্ভব হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ ও মুদ্রা ব্যয় কিভাবে সামলানো হবে, তা দেখার বিষয়।
আঞ্চলিক দৃষ্টান্ত
ইন্দোনেশিয়া বোয়িংয়ের কাছ থেকে ৫০টি উড়োজাহাজ কিনতে যাচ্ছে, যার বেশ কিছু হবে ৭৭৭ সিরিজের। ভিয়েতনামও ৭৮০ কোটি ডলারে ৫০টি ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের বোয়িং কিনছে। বাহরাইন ও থাইল্যান্ডও বোয়িংয়ের সঙ্গে বড় চুক্তি করেছে।
এতে এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।
২৫ বোয়িং কিনে শুল্কছাড়ের উদ্যোগ
ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো ‘বোয়িং কার্ড’ খেলে শুল্ক সমঝোতার পথে হাঁটছে বাংলাদেশও। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ১০টি নতুন উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করছে, যার মধ্যে মার্কিন বোয়িংয়ের নামও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২৫টি বোয়িং কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমরা কী কী পণ্য কিনব, যেমন—এয়ারক্রাফট, তুলা, সয়াবিন, গম—এসব বিষয় বাংলাদেশ থেকে দেওয়া ডকুমেন্টগুলোতে উল্লেখ করেছি।
তাদের কাছ থেকে ২৫টি বোয়িং কেনার উদ্যোগ নিয়েছি। সামরিক যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মাত্র কয়েক দিন আগে তাদের সঙ্গে গম কেনার চুক্তি করেছি। আমাদের ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে তুলা আমদানি বাড়ানোর কথা বলেছেন।’
বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘মার্কিন প্রশাসন ইন্দোনেশিয়ার বিষয়ে জানিয়েছে, তাদের ওপর ১৯ শতাংশ শুল্ক ধার্য করবে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে ২০ শতাংশ শুল্কের বিষয় উল্লেখ করে চুক্তি হতে পারে। আমরাও প্রত্যাশা করছি, ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ১৮ থেকে ২০ শতাংশের মতো শুল্ক নির্ধারণ করা হতে পারে বা এর চেয়ে কমও হতে পারে। আগামী ২৯ জুলাইয়ের ভার্চুয়াল মিটিংয়ের জন্যই অপেক্ষা করছি। এই কয় দিনের মধ্যে সে রকম প্রস্তাব আসতে পারে—এমন প্রত্যাশাও রয়েছে আমাদের।’
বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চাপ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকার দৃষ্টিতে ‘অসম’ হিসেবে চিহ্নিত। একক দেশ হিসেবে সর্ববৃহৎ বাজারটিতে বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও আমদানি করে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চমূল্যের পণ্য কিনে আমদানি বাড়াতে বলা হচ্ছে। বোয়িং কেনা সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি বোয়িং উৎপাদিত সামরিক পণ্য যেমন ট্রেইনার বিমান, রাডার সরঞ্জাম ও এয়ার সাপোর্ট যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কথাও আলোচনায় এসেছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘বাড়তি দামে দুই লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই আমদানি বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ইতিবাচক হবে, যা বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর দর-কষাকষিতে সুবিধা পেতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে—এমন প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ।’
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার দিচ্ছি। এ ছাড়া তুলা, গম, এলএনজি, সয়াবিন আমদানি বাড়াচ্ছি, এই খাতের ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করছি। আমরা দুই বিলিয়ন ডলারের মতো তুলা আনব, আধা বিলিয়ন ডলারের মতো গম ও এক বিলিয়ন ডলারের সয়াবিন। এতে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দ্রুত অর্ধেকে নেমে আসবে। ভিয়েতনামের বাণিজ্য ঘাটতি ১২২ বিলিয়ন ডলার, আর আমাদের মাত্র সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার। আমরা সোমবার যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছি বাণিজ্য আলোচনার জন্য। আশা করছি, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাব।’
বিমান বহর সম্প্রসারণ ও বোয়িংকে প্রাধান্য
বর্তমানে বিমানের বহরে রয়েছে ২১টি উড়োজাহাজ, যার মধ্যে ১৬টি বোয়িং এবং পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ টার্বোপ্রপ। ২০৩৪ সালের মধ্যে ৪৭টি উড়োজাহাজের বহর সম্প্রসারণের লক্ষ্য রয়েছে। নতুন পরিকল্পনায় ১০টি উড়োজাহাজ কেনা হবে, যার মধ্যে আটটি যাত্রীবাহী ও দুটি কার্গো। এসব উড়োজাহাজ দিয়ে আন্তর্জাতিক রুট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। বোয়িং ও এয়ারবাস উভয়ের কাছ থেকেই প্রস্তাব এসেছে, তবে ডেলিভারি সময়সীমা দীর্ঘ হওয়ায় বিমান এখন কিছু উড়োজাহাজ লিজেও নিতে চাচ্ছে।
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘আমাদের বিমান বহরের প্রায় সব এয়ারক্রাফট বোয়িং। আমাদের বিমানের ইনফ্রাস্ট্রাকচার যা আছে সেটাও বোয়িং। কাজেই বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার জন্য আমাদের কিছু আদেশ দেওয়ার কথা রয়েছে শিগগিরই। আমরা সেভাবে নেগোসিয়েশন করেছি বোয়িংয়ের সঙ্গে।’
অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
বোয়িংয়ের একটি উড়োজাহাজের মূল্য ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। পরিচালন ব্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকায় নতুন বিমান কেনা বিমান বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা না করে বোয়িং চুক্তি করা হয়, তবে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ও ঋণ পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করতে পারে।
কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে সম্প্রতি বোয়িং চুক্তি নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বোয়িং চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে বিবেচিত হবে, যার বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছু শুল্ক ছাড় পেতে পারে।
বিমানের বোয়িং ইতিহাস, ২ বিলিয়ন ডলারে ১০ উড়োজাহাজ
২০০৮ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ২১০ কোটি ডলারে ১০টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনে। এর মধ্যে ছিল ৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৩৭-৮০০ ও ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। এগুলো পেতে সময় লেগেছিল প্রায় এক দশক। ২০১৯ সালে চীন বাতিল করা দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার ছাড়ে কেনে বাংলাদেশ। এই অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, আগেভাগে অর্ডার না দিলে ভবিষ্যতের জন্য উড়োজাহাজ পাওয়া কঠিন।
বহর সম্প্রসারণের ‘পূর্ব পরিকল্পনা’
সম্প্রতি বিমান ১০টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে আটটি যাত্রীবাহী এবং দুটি কার্গো উড়োজাহাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিমানের দৈনিক যাত্রী ধারণক্ষমতা পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার হবে। নতুন উড়োজাহাজগুলো দিয়ে বিমানের আন্তর্জাতিক রুট যেমন অষ্ট্রেলিয়া, নিউইয়র্ক, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অঞ্চলে ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বোয়িং ও এয়ারবাস উভয় সংস্থার কাছ থেকে নতুন উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব পেয়েছে বিমান। তবে উড়োজাহাজ সরবরাহের সময়সীমা দীর্ঘ হওয়ায়, বিমান বর্তমানে অন্তত দুটি উড়োজাহাজ লিজের মাধ্যমে সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। উড়োজাহাজের অভাবে বিমান নতুন রুট চালু করতে পারছে না এবং কিছু রুটে ফ্লাইট সংখ্যা কমাতে হচ্ছে।’
বিশ্লেষকদের মত
এভিয়েশন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যদি বাস্তব চাহিদা ও রুট কাভারেজ বাড়ানোর পরিকল্পনার আলোকে এই বিনিয়োগ হয়, তবে তা লাভজনক হতে পারে। কিন্তু শুধু চুক্তির চাপেই যদি এসব বিমান কেনা হয়, তা হলে ভবিষ্যতে এর আর্থিক বোঝা দেশের ওপরই পড়বে।’
এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বোয়িং কেনা উচিত বিমানের ফ্লিট পরিকল্পনা ও বাজার চাহিদা বিশ্লেষণ করে। অতীতে দেখা গেছে, অনেক সময় বিমানের চাহিদা না বুঝেই ওপরের চাপ থেকে উড়োজাহাজ কেনা হয়েছে, যা আর্থিক বোঝা বাড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিমানের এই মুহূর্তে উড়োজাহাজ দরকার। কিন্তু তারা গত তিন-চার বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাটিয়েছে, এখনো সিদ্ধান্তে আসেনি। একবার বলে বোয়িং, আবার বলে এয়ারবাস। তারা সময়ক্ষেপণ করছে, সিদ্ধান্ত ত্বরিত নিতে হবে, দামও হতে হবে প্রতিযোগিতামূলক। ২০০৮ সালে বিমান যখন বোয়িং উড়োজাহাজ নিয়েছিল, তখন আমি বোর্ডে ছিলাম, সেই সময় আমরা যথেষ্ট নেগোসিয়েশন করে তবেই নিয়েছিলাম।’
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
সম্প্রতি ঢাকায় একটি গোলটেবিল আলোচনায় এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘আমার ৪০ বছরের ব্যবসাজীবনে এমন অনিশ্চয়তা আর দেখিনি। একদিকে বিশ্ববাজারে চাহিদা কম, অন্যদিকে মার্কিন শুল্ক নতুন করে চাপ হয়ে আসছে।’
পোশাক, চামড়া ও প্লাস্টিক পণ্য খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন শুল্ককাঠামো কার্যকর হলে পণ্যের দাম প্রতিযোগিতায় টিকবে না। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘শুল্ক আলোচনা নিয়ে সরকার যা করছে, তা ব্যবসায়ীদের জানানো হয়নি। বেসরকারি খাত গত এপ্রিলেই লবিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তখন সরকার বলেছিল, ‘আমরা দেখছি।’ এর পরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘এখনো বড় কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা যদি এক মাস আগে জানতাম ইউএসটিআর নয়, ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক নির্ধারণ করবে, তাহলে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে পারতাম।’