Image description
সিলেটে জুলাই হত্যা মামলার তদন্তে গতি নেই ১২০ দিনে মামলা তদন্তের বিধান থাকলেও কূলকিনারা হয়নি ৩৬৫ দিনেও

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সিলেটে শহীদ ও আহত হওয়ার ঘটনা ছাড়াও হামলার ঘটনায় ১৬টি হত্যাসহ ১৩৬টি মামলা হয়েছে। সিলেট জেলা ও সিটিতে দায়ের হওয়া এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। অথচ গত এক বছরে গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ৩০০ আসামি। এক বছরে মামলার তদন্তেও নেই তেমন অগ্রগতি। তদন্তের মন্থরগতি নিয়ে হতাশ শহীদ পরিবারসহ বাদীপক্ষ। শুধু তারা নন, আইনবিদরাও উদ্বিগ্ন তদন্ত নিয়ে।

আইনবিদ অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির মামলা তদন্তের মেয়াদ যেখানে ১২০ দিন, সেখানে ৩৬৫ দিন অর্থাৎ এক বছরেও মামলার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তদন্তে বিরাট অবহেলা-গাফিলতি হচ্ছে। গুলির ঘটনায় অস্ত্র বা কার্তুজ উদ্ধার, শহীদদের লাশের ময়নাতদন্ত, অপারগতায় ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি, ঘটনা-সংশ্লিষ্ট আলামত সংগ্রহ অত্যন্ত জরুরি ছিল। যদিও চরম উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঘটনার পরপরই অথবা মামলার পর এসব সংগ্রহে বিরাট গাফিলতি হয়েছে। এখন চাইলেও সেসব আলামত আর সংগ্রহ করা যাবে না। ফলে মামলাগুলোর ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কিত হতেই হচ্ছে। যথাযথ আলামত জব্দ ও হাজির না করলে স্পর্শকাতর মামলার আসামিরাও খালাস পেয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির মামলার আসামি পলাতক থাকলেও তদন্তে তেমন সমস্যা হয় না। তবে, কোনো মামলার আসামি সংখ্যা বেশি হলে নিরীহ-নিরপরাধ লোকজনের হয়রানির আশঙ্কা থাকে। অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকজন আইনজ্ঞ।

এনসিপি সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন শাহান যুগান্তরকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মামলার ন্যায়বিচার গোটা দেশবাসীর কাম্য। মামলাগুলোর অধিকাংশই স্পর্শকাতর। তাই তদন্তে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। শহীদ পরিবারের পাশাপাশি মামলার বাদীরা ন্যায়বিচারের জন্য অধীর অপেক্ষায়। তদন্তের প্রক্রিয়া ও মন্থরগতি নিয়ে বিভিন্ন মহল অভিযোগ তুলেছে। কোনো কারণে মামলাগুলোর তদন্ত যথাযথ না হলে কিংবা প্রলম্বিত হলে এর দায় অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের ওপরই বর্তাবে। আর আসামি গ্রেফতার নিয়েও অনেক গুঞ্জন রয়েছে। তবে মামলার নামে নিরীহ-নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হলে তা এনসিপি মেনে নেবে না।

সিলেটে শহীদ সাংবাদিক আবু তুরাবের ভাই আবুল আহছান মোহাম্মদ আজরফ হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, মামলার অগ্রগতি নিয়ে আমরা হতাশ। এসএমপি থেকে পিবিআই, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন মামলাটি তদন্তাধীন। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন পেশাদার সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার ঘটনার তদন্ত এখনো অনেক দূর। সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলনে প্রথম শহীদ শাবিপ্রবির ছাত্র রুদ্র সেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বড় বোন সুস্মিতা সেন হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক বছর হয়ে গেছে তবুও তদন্তের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। মামলার সাক্ষী আলী আব্বাস শাহিন বলেন, আমরা খুবই হতাশ। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই সরকার তারাও সেদিকে নজর দিচ্ছেন না।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সিলেটের এক অনুষ্ঠানে বলেন, নির্বাচনের আগে বিচার দৃশ্যমান হতে হবে। অন্তত দু-চারজন শীর্ষ অপরাধীর শাস্তিও হতে হবে নির্বাচনের আগেই।

সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মামলাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এ কারণেই হেডকোয়ার্টারের বিশেষ সেলের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। তদন্তে গাফিলতির কোনো সুযোগই নেই। আলামত সংগ্রহেই অনেক সময় চলে যাচ্ছে। তারপরও তদন্তকারীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি জানান, তদন্ত এগোয়নি এটা ঠিক নয়। অনেক মামলার তদন্তই অনেকদূর এগিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জে দুজনকে গুলি করে হত্যা মামলার চার্জশিট আগামী আগস্টের মধ্যে হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এমন সব বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. রেজাউল করিম, পিপিএম-সেবা বলেন, অনেক মামলা, সব মামলারই তদন্ত চলছে। পুলিশের সর্বোচ্চ মহল থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। তবে লাশের ময়নাতদন্ত না হওয়াসহ কিছু বিষয় তদন্তে কিছুটা স্থবিরতা আনছে। সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলা পিবিআইয়ের হাত ধরে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আরও কটি মামলার তদন্ত বেশ এগিয়েছে। তদন্তে মামলার অভিযোগের সত্যতা যাচাই, সত্যের সাথে মিথ্যার মিশেলে নিরীহ-নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

মামলায় আসামি যারা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান কেন্দ করে সিলেট জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকার থানাগুলোতে ১৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি হত্যা ও ১২০টি বিস্ফোরক ও হামলার ঘটনায় মামলা। আসামির সংখ্যা শুধু জেলায় সাড়ে ৯ হাজার। এর মধ্যে এজাহার নামীয় দুই হাজার ৩২১ জন এবং অজ্ঞাত সাত হাজার ১৮৫ জন। এর মধ্যে ১০২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন পাঁচটি মামলার বাদী।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) দায়ের করা ৯২ মামলায় আসামি ২০ হাজার ২২২ জন। এর মধ্যে এজাহার নামীয় ছয় হাজার ৪৮২ জন এবং অজ্ঞাত ১৩ হাজার ৭৪০ জন। এতে ১৭৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এদিকে, ১৬টি হত্যা মামলায় শীর্ষ অভিযুক্ত সিলেট-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তাকে গোলাপগঞ্জে সাতটি ও বিয়ানীবাজার থানায় দুটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। জেলা ও মহানগর এলাকায় দায়ের করা সর্বাধিক ৪৩টি বিস্ফোরক মামলার আসামি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম। তিনটি হত্যা মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

হত্যা মামলায় দ্বিতীয় অবস্থানে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ। তার বিরুদ্ধে আটটি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ৩৬টি মামলা রয়েছে। হত্যা মামলায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব। তিনি সাতটি হত্যা মামলাসহ অসংখ্য বিস্ফোরক মামলার আসামি। বিস্ফোরক মামলায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ৪১টি মামলা হয়েছে। এছাড়া হত্যা মামলায় যৌথভাবে ৪র্থস্থানে আছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম রাবেল, ফুলবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান হানিফ খান ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আলী আকবর ফখর। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ছয়টি করে হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। ২৬টি বিস্ফোরক ও দুটি হত্যা মামলা নিয়ে ৪র্থ স্থানে আছেন সিসিকের ৩২নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রুহেল আহমদ। ধারাবাহিক মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সিসিক ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আফতাব আহমদ খানের বিরুদ্ধে ২৫টি বিস্ফোরক ও দুটি হত্যা মামলা, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পিযুষ কান্তি দে’র বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে ২৫টি মামলা, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিটুর বিরুদ্ধে ২৪টি, মহানগর যুবলীগ সভাপতি আলম খান মুক্তির বিরুদ্ধে ২২টি বিস্ফোরক ও দুটি হত্যা, সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের বিরুদ্ধে ২০টি বিস্ফোরক ও তিনটি হত্যা, মৌলভীবাজার-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের বিরুদ্ধে ১৮টি বিস্ফোরক ও দুটি হত্যা মামলা হয়েছে।