
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগের দিন রোববার ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় স্কুলে অনুপস্থিত ছিল সাদ সালাহ উদ্দিন (৯)। ঘটনার দিন সোমবার কান্নাকাটি করে স্কুলে গিয়েছিল সে। কারণ, স্কুল ছিল তার প্রিয় জায়গা। সহপাঠী-বন্ধুরা ছিল প্রিয়। ভয়াবহ আগুনে সেই বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গেই সাদের ছোট্ট প্রাণ ঝরে পড়ল। মর্গে সাদের হাতে পরা লাল রঙের ঘড়ি দেখে বাবা সালাহ উদ্দিন মুকুল নিশ্চিত হয়েছিলেন, এটিই তাঁর সন্তান। সাদ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলা মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। বিমানটি সাদদের শ্রেণিকক্ষের ওপর আছড়ে পড়েছিল।

সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ক্যাম্পাসের ভবনের ওপর প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা সোয়া সাতটা পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। যদিও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিল। এরপর ওই দিন রাতে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা যান। যে কারণে গণমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা ৩২ উল্লেখ করা হয়েছিল। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩২ জন। এর বেশির ভাগই শিশু।
সাদ ছিল এই দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড়। সাদের ছোট বোন সারার বয়স দুই বছর। কক্ষের বিছানার পাশে সাদের পড়ার টেবিলে বই খাতা গোছানো। লাল রঙের ঘড়ির মতো নীল রঙের আরেকটি ঘড়ি ছিল টেবিলের তাকে। সেটিও সাদেরই।
গতকাল বুধবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর দিয়াবাড়িতে সাদদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় শোকাবহ পরিবেশ। আত্মীয়স্বজন এসেছেন। সাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে ওমানপ্রবাসী বড় চাচা আলাউদ্দিন টুটুল সপরিবার দেশে এসেছেন। ছোট চাচা মোহাম্মদ মাসুদ বৃহস্পতিবার (আজ) আসবেন অস্ট্রেলিয়া থেকে।

বসার কক্ষে গভীর বিষাদ নিয়ে বসে ছিলেন বাবা সালাহউদ্দিন মুকুল। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। আরেক কক্ষে মা খুকুমণি আক্তার স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় থেকে থেকে কেঁদে উঠছিলেন। কান্না ছাড়া তাঁর মুখে কোনো ভাষা ছিল না। সাদ ছিল এই দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড়। সাদের ছোট বোন সারার বয়স দুই বছর। কক্ষের বিছানার পাশে সাদের পড়ার টেবিলে বই খাতা গোছানো। লাল রঙের ঘড়ির মতো নীল রঙের আরেকটি ঘড়ি ছিল টেবিলের তাকে। সেটিও সাদেরই। দাদি বিউটি আক্তার সাদের পোশাক দেখিয়ে আহাজারি করছিলেন। দুষ্টুমির কারণে মা–বাবা বকা দিলে সাদের আশ্রয়স্থল ছিল দাদি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ছেলেরা বিদেশ থেকে ফোন দেওয়ার পর বুঝতে পারি ভয়ংকর কিছু ঘটছে। পরে টিভি খুলে দেখি, কিয়ামত হয়ে গেছে।’
ভাবে যদি প্রশিক্ষণ বিমান না উড়ত, তাহলে আমার সন্তান আজ মারা যেত না, কারও সন্তানকে মরতে হতো না। আমার ছেলের গল্প লেখার দরকার নেই। যদি রিপোর্ট করেন, তাহলে কারা দায়ী, তাদের কথা লেখেন। তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করেন। তাহলে বুঝব, আপনারা কিছু করেছেন।সাদের বাবা সালাহউদ্দিন মুকুল
হাতের ঘড়ি, প্যান্ট, মোজা ঠিক ছিল
সাদের দাদা ও নানাবাড়ি মুন্সিগঞ্জে। দিয়াবাড়িতে পরিবারটি ভাড়া বাসায় থাকে।সাদের শোকার্ত মা–বাবাকে সন্তান নিয়ে প্রশ্ন করতে মানা করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। সাদের বাবা নিজ থেকে কথা বলার আগপর্যন্ত কথা হয় স্বজনদের সঙ্গেই। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার চার ঘণ্টার বেশি সময় পর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে গিয়ে সাদের মরদেহের খোঁজ পাওয়া যায়। এর আগে কয়েকটি হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। ওই সময় সাদের মা–বাবার সঙ্গে ছিলেন একমাত্র ফুফা আবু সাঈদ মিলন।
দুষ্টুমির কারণে মা–বাবা বকা দিলে সাদের আশ্রয়স্থল ছিল দাদি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ছেলেরা বিদেশ থেকে ফোন দেওয়ার পর বুঝতে পারি ভয়ংকর কিছু ঘটছে। পরে টিভি খুলে দেখি, কিয়ামত হয়ে গেছে।’
প্রথম আলোকে আবু সাঈদ বলেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়ে সাদের বাবা অফিস থেকে ও মা বাসা থেকে স্কুলে ছুটে যান। পরে তিনি সাদের মা–বাবার সঙ্গে যোগ দেন। স্কুলে গিয়ে সাদের খোঁজ পাননি। কেউ একজন বললেন, দগ্ধ অনেক শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে। এরপর তাঁরা উত্তরার তিনটি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি রোগীদের মধ্যে খোঁজ করেন, মর্গেও খোঁজ করেন। কোথাও সাদ নেই। স্বজনদের আরেক দল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ করে পাননি। সব শেষে তাঁরা সিএমএইচে গিয়ে চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে খোঁজ করেন, সেখানেও সাদ নেই। সাদের খোঁজে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন তাঁরা। ওই সময় সাদের খোঁজ পাওয়া গেছে—এমন ভুয়া তথ্য দিয়ে কিছু ভুয়া কল এসেছিল, যা তাঁদের আরও বিষাদে ডুবিয়েছে।
মর্গ থেকে ছেলের পরনে কী কী ছিল, তার বর্ণনা চাওয়া হয়। তিনি বর্ণনা দেন। সে বর্ণনা মিলে যাওয়ায় তাঁকে লাশ দেখানো হয়। হাতে লাল রঙের ঘড়ি আর পরনে নেভি ব্লু আন্ডারপ্যান্ট ছিল সাদের। সেটি দেখার পর বাবা নিশ্চিত হন, এটি সাদ-ই।
আবু সাঈদ বলেন, সাদের বাবার অফিসের বস তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িটি সাদকে খোঁজার জন্য দিয়েছিলেন। সেটিতে চড়ে তাঁরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছিলেন। সিএমএইচে রোগীদের মধ্যে না পেয়ে সাদের মা–বাবাকে গাড়িতে রেখে তিনি সাদের ছবি নিয়ে মর্গে যান। সেখানে তাঁকে জানানো হয়, তিনটা লাশ রয়েছে। তবে তিনি শিশুর ফুফা জানার পর মর্গের দায়িত্বরত ব্যক্তি বলেন, একমাত্র মা–বাবা ছাড়া কারও লাশ শনাক্ত করার অনুমতি নেই। বাধ্য হয়ে তিনি গাড়ির কাছে ফিরে এসে সাদের বিপর্যস্ত বাবাকে নিয়ে মর্গে যান। মর্গ থেকে ছেলের পরনে কী কী ছিল, তার বর্ণনা চাওয়া হয়। তিনি বর্ণনা দেন। সে বর্ণনা মিলে যাওয়ায় তাঁকে লাশ দেখানো হয়। হাতে লাল রঙের ঘড়ি আর পরনে নেভি ব্লু আন্ডারপ্যান্ট ছিল সাদের। সেটি দেখার পর বাবা নিশ্চিত হন, এটি সাদ-ই।

আবু সাঈদ মিলন বলেন, সাদের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল, পেটের কাছে শার্ট পুড়ে গিয়েছিল, দুই হাতের কিছুটা ও চুল পুড়ে গিয়েছিল। তবে তার ঘড়ি, প্যান্ট, মোজা মোটামুটি ঠিক ছিল। তিনি জানান, মর্গে ছেলের লাশ পাওয়া গেছে জানার পর সাদের মা–বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। মা সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারান।
সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তর করে রাত ১০টার দিকে। রাত ১১টার দিকে বাসার নিচে জানাজা শেষে সাদকে সমাহিত করা হয় মিরপুর সাড়ে ১০ নম্বরে অবস্থিত কবরস্থানে। সেখানে সাদের দাদাও সমাহিত হয়েছিলেন।
আবু সাঈদ মিলন বলেন, সাদের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল, পেটের কাছে শার্ট পুড়ে গিয়েছিল, দুই হাতের কিছুটা ও চুল পুড়ে গিয়েছিল। তবে তার ঘড়ি, প্যান্ট, মোজা মোটামুটি ঠিক ছিল।
তাদের বিচার হতে হবে
সাদের ওমানপ্রবাসী চাচা আলাউদ্দিন টুটুল প্রথম আলোকে বলেন, সাদ নার্সারি থেকেই মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। তখন স্কুলে ইংরেজি ভার্সনে পড়ত। এ বছর তাকে বাংলা মাধ্যমে ভর্তি করা হয়। ইংরেজি ভার্সনের ক্লাসগুলো বিমান যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, তা থেকে অন্য পাশে ছিল।

আলাউদ্দিন টুটুল বলেন, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সাদকে ওর বাবা স্কুলে নিয়ে যেতেন। বেলা একটার সময় ক্লাস শেষ হতো। দেড়টার সময় কোচিং শুরু হতো। এই ৩০ মিনিটের বিরতিতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিত শিশুরা। যখন বিমান বিধ্বস্ত হয়, তখন শিশুরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ বিমান কীভাবে লোকালয়ে ওড়ার অনুমতি পায়, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ওই সময় সোফায় বসে থাকা সাদের বাবা সালাহউদ্দিন মুকুল প্রথম কথা বলেন। তাঁর কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘এভাবে যদি প্রশিক্ষণ বিমান না উড়ত, তাহলে আমার সন্তান আজ মারা যেত না, কারও সন্তানকে মরতে হতো না। আমার ছেলের গল্প লেখার দরকার নেই। যদি রিপোর্ট করেন, তাহলে কারা দায়ী, তাদের কথা লেখেন। তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করেন। তাহলে বুঝব, আপনারা কিছু করেছেন।’
সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সাদকে ওর বাবা স্কুলে নিয়ে যেতেন। বেলা একটার সময় ক্লাস শেষ হতো। দেড়টার সময় কোচিং শুরু হতো। এই ৩০ মিনিটের বিরতিতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিত শিশুরা। যখন বিমান বিধ্বস্ত হয়, তখন শিশুরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিল।সাদের ওমানপ্রবাসী চাচা আলাউদ্দিন টুটুল

সালাহউদ্দিনের ক্ষোভ কমছিল না। তিনি বলছিলেন, ‘স্কুলে গিয়ে যখন দেখি বিমানটা আমার ছেলের ক্লাস রুমে পড়েছে, তখনই বুঝেছি, আমার ছেলে নেই। আমার ছেলের ক্লাসের একজন চিপস কিনতে বের হয়েছিল, আরেকজন খাবার খেতে বাইরে বের হয়েছিল। ওই দুজন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। আমার ছেলে বেঁচে নেই। ওর বন্ধুরা বেঁচে নেই। মৃত্যুর সংখ্যা এত কম হতে পারে না। ভুয়া মৃত্যুর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। অনেক শিশু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমাদের সন্তানদের শহীদের মর্যাদা দিতে হবে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে।’ কথাগুলো বলে আবার চুপ করে গেলেন এই বাবা।