Image description
রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের অভিমত

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিন্ত এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সেই ঐক্য চোরাবালিতে ডুবতে বসেছে। এক দল অপর দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও উসকানিমূলক বক্তব্য এবং ব্যক্তিপর্যায়ে অশালীন মন্তব্য করায় নষ্ট হচ্ছে ঐক্য। এটি রোধে সরকারপক্ষ থেকে কার্যকর তেমন কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও তেমন কোনো উন্নতি নেই। এ পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এবং পতিত আওয়ামী লীগ উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। যার বড় উদাহরণ সম্প্রতি সচিবলায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাসহ বেশকিছু জেলায় বিক্ষোভ এবং চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ। বিশ্লেষক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা যুগান্তরকে বলেন, এ মুহূর্তে বিভেদ নয়, এখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যই সবচেয়ে জরুরি। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকেও আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ঘনঘন বসতে হবে দলগুলোকে নিয়ে। সেখানে ৫ আগস্ট ঘিরে দলগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্য ধরে রাখার পরামর্শ দেওয়াসহ সরকার গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে মতবিনিময় হতে পারে।

বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এর বড় কারণ বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেহাল অর্থনীতি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের ফিরে না যাওয়া অন্যতম। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট ঘোষণা আসা উচিত। একটি ক্রেডিবল নির্বাচন দেশকে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া অনুযায়ী সরকারের উচিত-নির্বাচন কবে হবে, তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া। একই সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্র কী অবস্থায় আছে, সেটি বোঝার জন্য মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনা যথেষ্ট। এ রাষ্ট্র ভেতর থেকে ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ভঙ্গুর রাষ্ট্র আরও অনেক কিছুকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। আমরা একটা সংকটের মধ্যে আছি।’ তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার সময় তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। সেসব নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। কাজেই এ নির্বাচনহীন অবস্থা থেকে মুক্তির সমাধান হচ্ছে-একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন। তাহলে সংকটের অর্ধেক সমাধান হয়ে যাবে। ৫ আগস্টের পর দেশে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা চোরাবালিতে ডুবে গেছে। এজন্য নির্বাচনের বিষয়ে সবাইকে ঐকমত্যে আসতে হবে।’

সোমবার রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। মর্মান্তিক এ ঘটনার পর মঙ্গলবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয় সোমবার রাত ৩টার দিকে। এ ঘটনা শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগসহ কয়েকটি দাবিতে মঙ্গলবার সচিবালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়। একই দিন উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দুই উপদেষ্টাকে ১০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ রেখে বিক্ষোভ হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পর্যবেক্ষণ-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলেও এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও তাদের নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও দেখা গেছে। যা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উদ্বেগের বিষয়। তবে এজন্য সরকারকে দায়ী করছে দলগুলো। একাধিক রাজনৈতিক দলের শীর্র্ষ নেতারা জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনদিন খারাপ হচ্ছে। অথচ সরকারের দৃশ্যমান তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। দলগুলোর সন্দেহ, সরকারের ভেতরে থাকা একটি গ্রুপ এবং বাইরের একটি অপশক্তি দেশের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এ সুযোগে মাঠে নামার চেষ্টা করছে পতিত আওয়ামী লীগ। সরকারের উচিত হবে সংসদ নির্বাচনের তারিখ সুস্পষ্ট করা। তাহলে সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

এমন প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার রাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবারও ১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে নেতারা যেখানেই ফ্যাসিবাদ, সেখানেই সম্মিলিতভাবে তা মোকাবিলার ঘোষণাও দিয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করা হলে অনেক সমস্যা এমনিতে কমে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা সহযোহিতা করবেন। পরে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐক্য আরও দৃশ্যমান করার কথা বলেন। এতে মানুষের মধ্যে স্বস্তিভাব আসবে। এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেছেন তাদের মধ্যে ঐক্য আছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছে, ফ্যাসিবাদ প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো রকম মতভিন্নতা, মতবিরোধ নেই। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, রাজনীতির মাঠে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কথা বলার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চারটি রাজনৈতিক দলের বৈঠকের পর মঙ্গলবার রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু সদস্যকে নিয়ে জনতা ও পুলিশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ার উদ্বেগজনক খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন একটি শোকাবহ মুহূর্তকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা থেকে এসব গোষ্ঠীর বিরত থাকা উচিত। ওই বিবৃতিতে তারেক রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং প্রতিটি সংকটকে সংহতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য অটুট আছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন, সেটা তিনি বাস্তবায়ন করবেন। এ বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া উচিত, যেন আর কোনো অস্পষ্টতা না থাকে। রাজনৈতিক দল হিসাবে আমরা চাই-দ্রুত নির্বাচন হোক এবং একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা পাক। রাজনৈতিক সরকার না থাকলে সমস্যাগুলো আরও বৃদ্ধি পায়, সেটা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মধ্যে দল ও মতের ভিন্নতা থাকবে। এই ভিন্নতা নিয়েই আমাদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, সমাজের শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। তাই দলমত, জাতিধর্মনির্বিশেষে আমাদেরকে নিবিড় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আমাদের অবস্থান থেকে আমরা সব সময় প্রস্তুত।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ বলেন, ‘যেভাবে গেট ভেঙে সচিবালয়ে প্রবেশের ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা শঙ্কাবোধ করছি, পতিত ফ্যাসিবাদ হয়তো সুযোগ নিতে চাইছে। ফ্যাসিবাদের পালাতক নেতাদের অনলাইন কার্যক্রমও তেমন ইঙ্গিতই দেয়। সেক্ষেত্রে আমাদের কষ্ট ও বেদনার সমাধান আমরাই করব; কিন্তু পতিত ফ্যাসিবাদ কোনো সুযোগ নিতে চাইলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করা হবে। কোনো অবস্থায়ই পতিত ফ্যাসিবাদকে সুযোগ নিতে দেওয়া যাবে না।’

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর বিভেদের কারণেই ফ্যাসিবাদ বারবার সুযোগ নিচ্ছে। আমরা ফ্যাসিবাদের পতনের পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছি এবং এটি রোধ করতে সরকার কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনঘন বসবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আশা করি, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য অটুট থাকবে।

বুধবার চাঁদপুরের পদযাত্রায় জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আবারও রাজনীতির মাঠে এলে আমরা সবাই মিলে তাদের প্রতিহত করব। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতে পারে; কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা আমাদের মধ্যে ঢুকে অরাজকতা তৈরি করবে, সেই সুযোগ আর এই বাংলাদেশে দেব না।’