
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক বছর হতে চললেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি । সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের পর বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনের ভঙ্গুর চিত্র আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে । এমন এক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও মতবিনিময় করলেন প্রধান উপদেষ্টা । বৈঠকে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছে দলগুলো ।
বৈঠকসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে । বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনা এবং এইচএসসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সচিবালয় ও মাইলস্টোন স্কুলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরিসহ নিকট অতীতে আরও কিছু ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে মতবিনিময়ে ডাকতে হয় দলগুলোকে ।
গত দুই দিনে ১৭ টি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা । রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই মতবিনিময়ে প্রথম দিন গত মঙ্গলবার ডাকা হয় বিএনপি , জামায়াতে ইসলামী , জাতীয় নাগরিক পার্টি ( এনসিপি ) ও ইসলামী আন্দোলনকে । আর গতকাল বুধবার ডাকা হয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন , গণসংহতি আন্দোলন , এবি পার্টি , নাগরিক ঐক্য , গণঅধিকার পরিষদ , এলডিপি , খেলাফত মজলিস , বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি , জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ( জেএসডি ) , ১২ দলীয় জোট, বাসদ , সিপিবি ও গণফোরামকে । এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চাওয়া । বৈঠক সূত্র বলছে , উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে ফ্যাসিবাদী শক্তি যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে , তারা বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে , এ বিষয়টি সবাইকে সতর্ক থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা । এ সময় সরকারের কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ।
বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় । আইনশৃঙ্খলাসহ সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার জন্য সমালোচনার পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দলগুলোর পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাসও দেওয়া হয় সরকারকে । দলগুলোর নেতাদের অভিযোগ , কেবল বেকায়দায় পড়লেই তাঁদের যমুনায় ডাকা হয় । মাসে অন্তত একবার হলেও সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজন করতে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানান তাঁরা ।
গত মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে গতকাল বুধবার বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর । সরকার ও দলগুলোর মধ্যে ঘন ঘন মতবিনিময়ের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন , ‘ সংকট তৈরি হলে প্রধান উপদেষ্টা ডাকেন । রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনা হলে সমস্যা তৈরি হতো না । ” একটি সূত্রের দাবি মঙ্গলবারের বৈঠকে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন খোদ প্রধান উপদেষ্টা নিজেই । দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন , যেসব ঘটনা ঘটেছে , তা মোকাবিলায় প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে । সংস্থাগুলোর আগাম তথ্য পেলে এড়ানো যেত । সচিবালয়ে গেট পর্যন্ত লোক চলে যাওয়ার আগে খবর পাওয়া যায়নি । বাহিনীগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না । দুই উপদেষ্টার অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জামায়াতের নেতারা ।
তাঁরা বলেন , নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উপদেষ্টারা কীভাবে গেলেন ? কী গোয়েন্দা তথ্য ছিল ? উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলের সহায়তায় উদ্ধার সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে । বৈঠকের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন , ' বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুলে দুজন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিবকে শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল । একই দিনে সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় । কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তির আবার উত্থানের একটা নমুনা দেখার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে । আমরা আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলে এসেছি ।”
তবে দুর্ঘটনা - পরবর্তী সরকারের পদক্ষেপে কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা ছিল মন্তব্য করে ফখরুল বলেন , ‘ এটা অভিজ্ঞতার অভাব । এ সরকারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো তাদের অনভিজ্ঞ লোকই বেশি , অভিজ্ঞরা কম আছে । কারও কারও ইগো সমস্যা আছে । সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা , পরামর্শ করা — এ বিষয়ে তারা একটু পিছিয়ে । ”
বৈঠক প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন , প্রশাসনিক ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলার অবনতি এখন সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান । দেশে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চলছে এবং গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক কিছু দুর্বলতা রয়েছে । এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি ।
গতকাল বুধবার বৈঠক শেষে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন , ‘ সংস্কার ও সঠিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে সংশয়ের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি । তাঁকে বলেছি , আপনি যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে না পারেন, আবার ভালো নির্বাচনও নিশ্চিত করা সম্ভব না মনে করেন , তাহলে পদত্যাগ করে চলে আসুন । সংস্কার ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আগ্রহী সকল পক্ষ মিলে আপনার নেতৃত্বে আমরা একটা নির্বাচনী অ্যালায়েন্স করি । ”এদিকে নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে দলগুলোর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয় । দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে , নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন । তিনি বলেছেন নির্বাচন হওয়া দরকার । নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে । রাজনৈতিক দলগুলো ওই পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ।
এদিকে গতকাল সকালে মতবিনিময় শুরুর পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে ১০ মিনিটের জন্য প্রতীকী ওয়াকআউট করে সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ । তবে বেলা ১১ টা ২৫ মিনিটের দিকে তারা আবার সংলাপে যোগ দেন । সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সাংবাদিকদের বলেন , ' প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি , আপনারা তো সবকিছু পারলেন না । সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে বলে দিন । তারা যদি সে পথে হাঁটে , আমরা সবাই মিলে যদি হাঁটতে পারি , তাহলে সংকট দূর করতে পারব । '
প্রিন্স অভিযোগ করে বলেন , কোনো কোনো দলের প্রতি আপনার মায়া - মমতা বেশি থাকে এবং আপনার দল হিসেবে চিহ্নিত হয় , তাহলে সংকট কাটবে না । এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বলেন , বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটা অংশ এনসিপি নামে একটা সংগঠন তৈরি করেছে । এই এনসিপি যেখানেই মিটিং করতে যায় , সেখানেই তারা পুলিশ প্রহরা , মিলিটারি প্রহরা , র্যাবের প্রহরায় বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্ন রকম সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করার জন্য সুযোগ পাচ্ছে । তো এটা সরকারের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটা বৈষম্য সৃষ্টি করার সমান । লন্ডন বৈঠকের পর দেশে ফিরেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় করা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ।
তিনি বলেন , বিচার , সংস্কার এবং নির্বাচনের ব্যাপারে উচিত ছিল দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করা । সেটা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে । যত দিন যাচ্ছে , দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তত খারাপ হচ্ছে । প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির ( এনসিপি ) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন , গোলাপগঞ্জে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি । দৃষ্টান্তমূলক ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া দরকার । তিনি বলেন , আওয়ামী লীগ হয়তো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবে , তবে যদি প্ৰশাসন সঠিকভাবে কাজ করে , তবে কেউই অপব্যবহার করতে পারবে না ।