Image description
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল » ছিল না জরুরি বের হওয়ার পথ । » আগুন আর ধোঁয়ায় পরিবেশ ছিল দমবন্ধকর । » বারান্দাগুলোও লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো ।

রাজধানীর দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনটির কাঠামোই দৃশ্যত সোমবারের বিপর্যয়কে এতটা প্রাণঘাতী করে তুলেছে । সরেজমিন ঘুরে এবং ভুক্তভোগী অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে । মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি শাখার মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পরই দেখা গেছে একটি টেনিস কোর্ট ও ক্যানটিন । এরপরই হায়দার আলী ভবন । পশ্চিমমুখী হায়দার আলী ভবনটি দোতলা । তবে দ্বিতীয় তলার ছাদটি টিনের ছাউনির । দোতলা ভবনটির মাঝ বরাবর সিঁড়ি, দুই পাশে কক্ষ । নিচতলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং ওপরতলায় পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের পাঠদান চলে । প্রতিটি ক্লাসে ৩৫-৪৫ জন শিক্ষার্থী । দুটি তলায় মোট ১৬ টি শ্রেণিকক্ষ থাকলেও ভবনে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ একটাই । ছিল না অগ্নিকাণ্ডের মতো বিপর্যয়ের সময় বের হওয়ার জরুরি পথ । 

বারান্দাগুলোও লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো । একজন শিক্ষক এই প্রতিবেদককে ভবনের শ্রেণিকক্ষগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন । তিনি জানান , ভবনটির নিচতলার বাঁ দিকে সিঁড়ির পাশেই শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষ । এরপরই পরপর পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ । সেখানে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি ও বাংলা ভার্সনের পাঠদান হয় । এরপর একটি ওয়াশরুম । একটু আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সঙ্গে চলে গিয়েছিল । কিছু শিক্ষার্থী ছিল মা- বাবার অপেক্ষায় । কিছুসংখ্যক রয়ে গিয়েছিল কোচিংয়ের জন্য । নিচতলার ডান দিকে প্রথমে একটি ওয়াশরুম, এরপর ভাইস প্রিন্সিপালের অফিস । তার পাশেই ইংরেজি ভার্সনের সমন্বয়কারী মাহরীন চৌধুরীর কক্ষ । ২০ টি শিশুকে স্কুল ভবনটা একটা খাঁচার মতো বাঁচিয়ে যিনি প্রাণ দিয়েছেন । এরপরই মেয়েদের তিনটি শ্রেণিকক্ষ । দোতলার বাঁ পাশে যথাক্রমে একটি ল্যাব রুম, চারটি শ্রেণিকক্ষ এবং একটি ওয়াশরুম । সেখানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান হয় । দোতলার ডান পাশে প্রথমে একটি ওয়াশরুমের পর পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ । সেখানে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠদান হয় । বিকল বিমানটি পড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার সময় সব ক্লাসের ছুটি হয়ে গিয়েছিল । অর্থাৎ মা-বাবার সঙ্গে বাইরে চলে না যাওয়া অন্য শিক্ষার্থীরা অপেক্ষমাণ ছিল ।

একাধিক শিক্ষার্থী , অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে । ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণিতে পড়া রাহিম তাসকিন আহমেদ সেদিন কিছুটা আহত হয়েছে । আগুনের শিখায় তার দুই কান ঝলসে গেছে । বন্ধু হারানোর বেদনায় কাতর তাসকিন নিজের শারীরিক কষ্ট যেন ভুলেই গেছে । রাহিম গতকাল এসেছিল ঘটনার দিন ফেলে যাওয়া বইয়ের ব্যাগ নিতে । ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে বলল , ‘ আমাদের ছুটি হয়ে গেছিল । ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ায় সবাইকে বের করে দেওয়ার পর আমি বের হই । ব্যাগ কাঁধে তুলব এমন সময় টিনের চালের ওপর আমরা একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনি । পরপর আরও দুইটা বিকট শব্দ হয় । তৃতীয় শব্দটা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ । দ্বিতীয় শব্দের পর মিনিটখানেকের মধ্যে কালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গেল । আর তৃতীয় শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই আগুন লেগে যায় । আমি জ্বলন্ত বিমানের পাশ দিয়ে লাফিয়ে বের হই । আমার তিন বন্ধু গায়ে আগুন লেগে মারা গেছে । সেই দৃশ্য আর মনে করতে চাই না ! ” ঘটনার সময় স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল । তবে কিছু শিক্ষার্থী কোচিং ক্লাস ও অভিভাবকের জন্য অপেক্ষা করছিল । এ ছাড়া শিক্ষক ও স্টাফরাও ছিলেন ভবনের ভেতরে । কয়েকজন শিক্ষক জানান , নিচতলার সিঁড়ির পাশে শিক্ষকদের কক্ষ , যেখানে শিক্ষকেরা অবস্থান করছিলেন ।

বাংলা ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিদ মোল্লা বলল , প্রতিদিন ছুটির পর সে ঠিক যে জায়গায় দাঁড়ায় , সেখানেই যুদ্ধবিমানটি পড়েছে । এক বন্ধু ডেকে ক্যানটিনে নিয়ে না গেলে সে হয়তো ওখানেই থাকত । কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছে , আগুন লেগে যাওয়ার পর আটকে গিয়ে তারা জানালা ও বারান্দার গ্রিলের ভেতর থেকে চিৎকার করতে থাকে । সেনাবাহিনীর দল ও ফায়ার সার্ভিস কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে দোতলার টিনের চাল ও নিচতলার গ্রিল কেটে শিক্ষার্থীদের বের করে । শিক্ষার্থীরা ছাড়াও গতকাল স্কুলের সামনে যাওয়া কয়েকজন অভিভাবক হায়দার আলী ভবনের কাঠামোগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তুললেন । তাঁদের প্রশ্ন , যেখানে কয়েক শ শিক্ষার্থী একসঙ্গে ক্লাস করে , সেখানে কেন একটিমাত্র প্রবেশপথ থাকবে ? শিক্ষার্থী , অভিভাবক ও শিক্ষকেরা বলেছেন , ভবনের বারান্দায় গ্রিল না থাকলে অনেকে হয়তো বের হতে পারত ।

রফিক নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘ভবনটি একটা খাঁচার মতো । একটিই প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ । ভবনটি খোলামেলা হলে বাচ্চারা বের হতে পারত । বারান্দাও গ্রিল দিয়ে ঘেরা । তাই নিচতলায় থেকেও অনেকে বের হতে পারেনি । এদিকে গতকাল মাইলস্টোন স্কুলের মূল ফটকসহ পাঁচটি প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ । ভবনের সামনে মোতায়েন করা হয় নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী । কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি , এমনকি অভিভাবকেরাও প্রবেশ করতে পারেননি । শুধু শিক্ষকদের পরিচয়পত্র দেখে জরুরি সভার জন্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় । সংবাদকর্মীদের প্রবেশেও বাধা দেওয়া হয় । চার - পাঁচজন শ্রমিককে হায়দার আলী ভবনের তিন পাশে টিনের বেড়া দিতে দেখা যায় । গতকাল ভবনের জানালা দিয়ে দেখা গেছে , এখনো পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া বই , টিফিন বক্স , পানির বোতল , ব্যাগ । কিছু ব্যাগ ও বই - খাতা উদ্ধার করে রাখা হয়েছে , যা ধীরে ধীরে অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে ।