
আফিয়া উম্মে মরিয়ম। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের পর থেকে এখনো খোঁজ মিলছে না তার। আফিয়ার খোঁজে দুর্ঘটনার পর থেকে স্কুলে, হাসপাতাল ও মর্গে ছুটছে পরিবার। ওইদিন শিশুটির মা উম্মে তামিমা তাকে স্কুল থেকে বাসায় নেয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। নিখোঁজ শিশুটির পরিবার তাকে খুঁজতে উত্তরাসহ সব হাসপাতালে গেলেও পায়নি। কোনো হাসপাতালের ভর্তির তালিকায়ও নেই শিশুটির নাম। হাসপাতাল-মর্গে কোথাও খুঁজে না পেয়ে আবারো ফিরেন স্কুলে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে খুঁজে ফিরছেন প্রিয় সন্তানের চিহ্ন। শিশুটির খোঁজ না মেলায় ভেঙে পড়েছেন পরিবার। দুই ভাই-বোনের মধ্যে আফিয়া ছোট। আফিয়ার একমাত্র ভাই দিন-রাত কেঁদেই যাচ্ছে। এদিকে-সেদিকে খুঁজছে বোনকে।
আফিয়ার ফুফাতো ভাই ফাহিম আহম্মেদ শান্ত মানবজমিনকে বলেন, প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আফিয়াদের ক্লাস শুরু হয়। ওইদিন স্কুল থেকে বাসায় আনতে ক্লাস শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে ওর মা বাসা থেকে বের হয়। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে আফিয়া ছিল ছোট। ঘটনার দিন থেকেই তার কোন খোঁজ মিলছে না। আমরা পাগলের মতো খুঁজছি। কোনদিকে যাবো, কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। উত্তরা থেকে ঢাকা পর্যন্ত এমন কোনো হাসপাতাল নেই যে, আমরা খুঁজিনি। এক এক হাসপাতালে আমরা চার-পাঁচবারও গিয়েছি। যে সকল হাসপাতালে মর্গ রয়েছে সেখানেও খুঁজেছি। যে মরদেহগুলো আছে সেগুলো শনাক্তের জন্য ডিএনএ টেস্টের জন্য বলেছে।
তিনি বলেন, আফিয়ার মা উম্মে তামিমা বাবা আব্দুল কাদের। ওর বাবা ব্যবসা করেন। বাবা-মা দু’জনে একেবারে ভেঙে পড়েছে, কিছুতেই মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। তিনদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো সন্ধান পাচ্ছে না মেয়ের। কীভাবে বাবা-মা ঠিক থাকে! আফিয়ার বাবা মঙ্গলবার মালিবাগে সিআইডি অফিসে গিয়ে ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা দিয়ে এসেছেন। আর ওর মা নমুনা দিয়ে এসেছেন গতকাল। সেখান থেকে বলেছে ৫-৬ দিন সময় লাগবে রিপোর্ট আসতে।
আফিয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আফিয়া খুব মেধাবী ছিল। এতটুকু বয়সে সবকিছুতে খুব সিরিয়াস ছিল। সারা ঘর মাতিয়ে রাখতো। গল্প করতে ভালোবাসতো। এখন তো ওদের খেলাধূলা করার বয়স ছিল, আকাশে বিমান এলে দেখতে দৌড়ে যেতো। কিন্তু সেই প্লেন নিভিয়ে দিলো এতগুলো শিশুর জীবন। ওর বাবা-মা সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন প্রায়। ঘুম নেই কারও চোখে। এত ছোট বাচ্চাকে হারিয়ে কী করে তারা ঠিক থাকবে। এতটুকু বাচ্চা সম্পর্কে এখনো কিছুই জানছে না। কোথায় আছে, কেমন আছে। কোন হাসপাতালে আছে, না কী হয়েছে। আমরা তো আর আশা ছেড়ে দিতে পারি না। ডিএনএ টেস্টে কি রেজাল্ট আসে সেটির অপেক্ষায় আছি।
ফাহিম আহম্মেদ বলেন, এমন ঘটনা হবে সেটি আমাদের কল্পনাতে কখনো আসেনি। অনেক খালি মাঠ ছিল আশপাশে। এতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা মারা গেল। জীবনকে বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়ে গেল। ওর ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ে। তার কান্না থামছে না, কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় বোনের খোঁজে কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। সেও মাইলস্টোনে পড়তো কিন্তু এক বছর হলো তাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে আমাদের পরিবারে তিনজনই মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। ঘটনার দিন আমার আরেকটি ছোট ভাই দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল তাকে আমি উদ্ধার করে নিয়ে আসি। সে সুস্থ আছে, ভালো আছে। আরেক বোন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে ঘটনার আগেই বের হয়ে আসে। কিন্তু আফিয়ার কোনো খোঁজ মিলেনি। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই সে নিখোঁজ। কোথায় গেলে পাবো আমার বোনকে? কোথায় আছে আমার বোন।
এদিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর যেসব নিখোঁজ ব্যক্তির নাম আহত বা নিহতদের প্রকাশিত তালিকায় নেই, তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিবাগে সিআইডি ভবনে গিয়ে ডিএনএ নমুনা দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান এক বিবৃতিতে এ অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নিখোঁজদের মধ্যে মাত্র একটি পরিবারের পক্ষ থেকে নমুনা দেয়া হয়েছে। নিখোঁজ সব পরিবারের সদস্যের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা গেলে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ডিএনএ ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সবার সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সিএমএইচ মর্গে বর্তমানে রাখা ছয়টি মরদেহ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যে এসব মরদেহ থেকে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিআইডি ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হবে।