Image description
 

ঢাকায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পুরো দেশ এখন শোকে কাতর। শোকের এ ছায়া পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তেও। এতগুলো কোমলমতি শিশুর প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়া কেউ মানতে পারছে না। সন্তান কিংবা স্বজনহারা পরিবারগুলোও শোকে স্তব্ধ। তাদের বুকের ওপর এখন কেবলই কান্নার জমাট পাথর।

গত সোমবার দুপুরে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত যারা হতাহত হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ওইদিন স্কুল ছুটির পরপরই ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে জীবন থেকেই ছুটি নিয়ে অনন্তযাত্রায় শামিল হয় অনেক বাবা-মায়ের বুকের প্রাণপাখিরা।

 

সরেজমিনে মাইলস্টোন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, পুরো আঙিনায় সুনসান নীরবতা। চারপাশের বাতাসে যেন বোবা কান্না। নেই ছোট ছোট ফুলকলিদের ছোটাছুটি আর কোলাহল। মাইলস্টোনের আকাশও যেন শোকে নত হয়ে আছে ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের ওপর। প্রধান ফটকটিও বন্ধ। পুরো শিক্ষাঙ্গন স্তব্ধতায় মোড়ানো।

মাইলস্টোন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সিফাত। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে নিজে বেঁচে গেলেও সে-ও হারিয়েছে অনেক চেনা মুখ। কথা বলতে বলতে বারবার মাথা নিচু করে রাখা সিফাত যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজছিল।

 

 

মাইলস্টোনের আকাশও যেন শোকে নত, উড়োজাহাজ উড়লেই কাঁপছে বুক

‘এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমার অনেকেই পরিচিত ছিল। আমার মায়ের সঙ্গেও অনেক সহপাঠীর মায়ের সম্পর্ক ছিল। কী থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না’- জাগো নিউজকে বলছিল সিফাত।

বাচ্চাদের পুড়ে যাওয়া অংশে হাত দেওয়া যায়নি। আমি হাত দিতে গিয়ে দেখি আমার হাতও পুড়ে গেছে। তাহলে এই আগুনের তাপ কিভাবে সহ্য করেছে ওরা। শুধু আমি না, যারাই পুড়ে যাওয়া শিশুকে ধরতে গেছে তারাই পুড়ে গেছে। এমন শক্তিশালী আগুন আমি জীবনেও দেখিনি।- মাহমুদা চৌধুরী

মাইলস্টোন কলেজে ‘এফ-৭ বিজিআই’ মডেলের যুদ্ধবিমানটি যখন আছড়ে পড়ে তখন স্কুল শাখায় প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অতিরিক্ত ক্লাস চলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে বিমানটি ভেঙে পড়লে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

 

‘ঘটনার সময় আমাদের প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির অতিরিক্ত ক্লাস চলছিল। বিকট শব্দে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। শিক্ষকরা দ্রুত আমাদের নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছিলেন’- জানায় সিফাত।

 ওইদিন স্কুল ছুটির মাত্র মিনিট দশেক পরই বিমানটি স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ছুটির পর অভিভাবকের জন্য অপেক্ষা করছিল। কেউ কেউ স্কুল ছুটির পর সেখানে অতিরিক্ত ক্লাসে ঢুকে পড়ে। বিকট শব্দ শুনে আশপাশের অনেকে স্কুলের দিকে ছুটে যান। অভিভাবকদের অনেকে তখন বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিলেন। তাদের কেউ কেউ শব্দ শুনেই বুঝতে পারেন, তার বুকের মানিক হয়তো আর বেঁচে নেই।

 

মাইলস্টোনের আকাশও যেন শোকে নত, উড়োজাহাজ উড়লেই কাঁপছে বুক

ততক্ষণে বিধ্বস্ত বিমানের ভাঙা অংশ অনেক শিশুর শরীর ঝলসে দেয়। তারা পোড়া শরীর নিয়েই দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। কেউ কেউ বাবা-মাকে খুঁজে পায়। তখন সন্তানের শরীরে হাত দিয়ে অনেক বাবা-মা চমকে উঠেন। কারণ, আগুনের তাপ ছিল অনেক বেশি। এরপর লেলিহান শিখা থেকে শিশুদের উদ্ধার করতে গিয়ে অনেকে গুরুতর আহন হন সেই আগুনে।

স্বজনদের দাবি, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় জেট ফুয়েল বা অ্যাভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় আগুনের তাপ বেশি হয়। যে কারণে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মাহমুদা চৌধুরী নামে ভুক্তভোগী এক অভিভাবক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাচ্চাদের পুড়ে যাওয়া অংশে হাত দেওয়া যায়নি। আমি হাত দিতে গিয়ে দেখি আমার হাতও পুড়ে গেছে। তাহলে এই আগুনের তাপ কিভাবে সহ্য করেছে ওরা। বিমানের জ্বালানির আগুনের তাপ অনেক অনেক বেশি। শুধু আমি না, যারাই পুড়ে যাওয়া শিশুকে ধরতে গেছে তারাই পুড়ে গেছে। এমন শক্তিশালী আগুন আমি জীবনেও দেখিনি।’

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মূলত স্কাই, অলিভ, ব্লু ও ক্লাউড সেকশনে ভাগ করে পাঠদান করানো হয় সেখানে। স্কাই ও অলিভ সেকশনটি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। স্কাই ও ব্লু সেকশনের বাচ্চারা বেশি হতাহত হয়েছে।

আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আর মাত্র ৫ মিনিট দেরি হলে আমার বাচ্চাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। ও ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ঘটনাস্থলেই ছিল ওর ক্লাসরুম। ওইদিন স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসার পরই বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে গিয়ে দেখি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলের ওপর পড়েছে- সাদিকুন নাহার

বিমানটি যেখানে বিধ্বস্ত হয় ঠিক সেই ভবনেই ছিল আরাবি আহমেদের ক্লাসরুম। ওইদিন দুপুর ১টায় স্কুল ছুটির পর ৫ মিনিটের মধ্যে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তার মা সাদিকুন নাহার। এর মিনিট কয়েক পরই ঘরে ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনা।

মাইলস্টোনের আকাশও যেন শোকে নত, উড়োজাহাজ উড়লেই কাঁপছে বুক

‘আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আর মাত্র ৫ মিনিট দেরি হলে আমার বাচ্চাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। ও ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ঘটনাস্থলেই ছিল ওর ক্লাসরুম। ওইদিন স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসার পরই বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে গিয়ে দেখি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলের ওপর পড়েছে’- বলছিলেন সাদিকুন নাহার।

মাইলস্টোনের প্রধান ফটক বন্ধ থাকলেও পাশ দিয়ে দুই মিনিট হেঁটে এগোলেই চোখে পড়বে বিধস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ। দুই তলা ভবনের পেছনের অংশ ফুঁড়ে বের হয়ে গেছে বিমানের কিছু অংশ। ভবনের পেছনে গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। নাকে আসছে জেট ফুয়েলের উৎকট গন্ধ। যে চেয়ার-টেবিলগুলোতে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতো সেগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলে প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি চলছে। কয়েকজন বালক ইতিউতি করছিল। কখনো মূল ফটক, কখনোবা দেওয়ালের ওপর দিয়ে উঁকি মারছিল। চোখে-মুখে তাদের আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। হয়তো প্রিয় বন্ধুটির খোঁজ না মেলায় বিষাদে বিবর্ণ তাদের মুখাবয়ব।

বুধবার সকাল থেকেই কলেজ প্রশাসন প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করেছে৷ ভেতরে চলছে স্কুল কর্তৃপক্ষের মিটিং। শিক্ষক, কর্মকর্তাদের গাড়ি আসছে, কখনোবা বের হচ্ছে। তবে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্বজন বা উৎসুক কাউকে এদিন আর তেমন একটা দেখা যায়নি। দেশি-বিদেশি কিছু গণমাধ্যমকর্মী ছিলেন বাইরে অপেক্ষমান।

মাইলস্টোনের আকাশও যেন শোকে নত, উড়োজাহাজ উড়লেই কাঁপছে বুক

সেখানে গিয়ে কথা হয় মারুফ সরকার আদিব নামে একজনের সঙ্গে। যার চোখের সামনে পুরো ঘটনাটি ঘটেছে।

‘বিমানটা যেখানে পড়ছে, সেখানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। খেলা ছিল। ইংলিশ ভার্সনের সঙ্গে ফাইট দিতে গেছিলাম৷ একটা ফ্রেন্ড ডাক দিসে, আইসা পড়ছি। একটু সামনে গেছি। এক মিনিট বা ৫০ সেকেন্ড হবে। তখনই বিকট আওয়াজে কিছু একটা পড়ছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি ধোয়া, আগুন। তখন বন্ধুরা সব পাশেই ছিল। চোখের সামনে দেখলাম বন্ধু ফুয়াদের হাত, এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে রক্ত’- এভাবেই ঘটনার বর্ণনা করছিলেন আদিব।

মাইলস্টোনের বাংলা ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির এ শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘শানকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ পরে জানতে পেরেছি, ও জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আছে।’

‘ফুয়াদের খোঁজ এখনো মেলেনি। কোথাও নেই। কেউ বলতে পারে না। ওর বাবা-মায়ের নাম কিংবা ফোন নম্বরও জানি না। স্যারদের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। ওর খবর কেউ বলতে পারেননি’- বলছিল দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এ শিক্ষার্থী।

আদিব তো তবু কিছু বলতে পারছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রেজোয়ান আমিন নাবিলের মুখ দিয়ে কথা বেরোনোর আগেই যেন তার হাত-পা কাঁপছিল। ভয়াবহ সেই মুহূর্তের দৃশ্য যেন কিছুতেই তাকে স্থির হতে দিচ্ছিল না। বন্ধুর খোঁজ না মেলায় ভেতরের অস্থিরতাটুকু ভেসে উঠে তার চোখেমুখে।

শানকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ পরে জানতে পেরেছি, ও জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আছে। ফুয়াদের খোঁজ এখনো মেলেনি। কোথাও নেই। কেউ বলতে পারে না। ওর বাবা-মায়ের নাম কিংবা ফোন নম্বরও জানি না। স্যারদের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। ওর খবর কেউ বলতে পারেননি।- মারুফ সরকার আদিব

‘কেউ যদি একটু খোঁজ দিতে পারতো। সেদিন আমাদের সঙ্গেই ছিল ফুয়াদ। ও তো হোস্টেলে থাকতো। তাই বাবা-মায়ের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমাদের। পরিবার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিও না’- বলছিল নাবিল।

ভয়ঙ্কর সেই বিমান দুর্ঘটনার তিনদিন পার হয়ে গেল। মাইলস্টোনের আকাশে আজ হালকা রোদ৷ ভ্যাপসা গরম। নাবিলের চোখে ঘাম, নাকি অশ্রু ঠিক বোঝা গেল না৷

মাইলস্টোনের আকাশও যেন শোকে নত, উড়োজাহাজ উড়লেই কাঁপছে বুক

তবে, বিমান দুর্ঘটনায় ঠিক কতজন শিক্ষার্থী মারা গেছে তার সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য আসছে। কেউ বলছে, একশোর বেশি হবে, কারও কথায় তা প্রায় দুইশো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নানান তথ্য ঘুরছে। এতে ধোঁয়াশা যেমন বাড়ছে, বিভ্রান্তও হচ্ছেন অনেকে।

শিক্ষার্থী এ এইচ নোমান রেজা বলেন, ‘অনেক ইউটিউবার ও ফেসবুক লাইভ থেকে নিহতের সংখ্যা নিয়ে মনগড়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এসব তথ্য কেউ বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।’

গত দুইদিনে দূরদূরান্ত থেকে অনেকে ছুটে এসেছেন মাইলস্টোনে। প্রবেশমুখে মানুষের জটলা ধীরে ধীরে কমে আসছে। কমছে না শুধু কৌতূহল। প্রতিদিনেই মতোই কিছুক্ষণ পরপর মাইলস্টোন স্কুলের মাথার ওপর দিয়ে সাই সাই শব্দে উড়ে যাচ্ছে উড়োজাহাজ। সেই শব্দে আশপাশের মানুষের বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্বজনদের চোখে হয়তো ভাসছে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মুখের ছবিগুলো।