
দেশে নারী ও যুবদের ওপর সহিংসতা, সড়কে উত্ত্যক্ত-যৌন হেনস্তা, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত পড়ছেন নানামুখী নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। তাৎক্ষণিকভাবে আত্মরক্ষার উপায় জানা না থাকায় অনেক সময় এসব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার কিছু মৌলিক কৌশল জানা থাকলে বাড়ে আত্মবিশ্বাস। তা ছাড়া একবার এ কৌশল রপ্ত করতে পারলে প্রয়োজনের সময় তা কাজেও লাগতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ যুবদের (১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত যুবক-যুবতী) জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেসব কৌশলের মাধ্যমে হেনস্তাকারী বা দুর্বৃত্তদের মোকাবিলার শক্তি অর্জন করতে পারবেন যুবরা।
এ বাস্তবতা বিবেচনায় যুবক-যুবতীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এজন্য ‘যুবদের আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যার লক্ষ্য যুবসমাজকে আত্মরক্ষার প্রাথমিক কৌশলে প্রশিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে স্থানীয় যুবক-যুবতীদের আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশল শেখাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আত্মরক্ষার কৌশল প্রশিক্ষণ প্রকল্পটির প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, অনুমোদন পেলে প্রকল্পটি চলতি বছরের ১ আগস্ট শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। যার আওতায় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮ হাজার ৮৫০ যুবক-যুবতীকে আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশল শেখানো হবে। এর মধ্যে ৮ হাজার ২৫০ জন যুবক এবং ৬০০ যুবতী। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ কোটি ৯৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, সেগুলো এরই মধ্যে বিকেএসপিতে চালু রয়েছে। তবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এ ধরনের প্রকল্প এর আগে বাস্তবায়ন করেনি। এবারই প্রথম বড় পরিসরে যুবক-যুবতীদের আত্মরক্ষার মৌলিক প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ মন্ত্রণালয়। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদনের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল প্রথম আলোচ্য প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। তবে সেই প্রস্তাবনায় কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকায় সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। পরবর্তী সময়ে ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধন করে অর্থায়নের বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতি নিয়ে গত ১৫ জুলাই আবারও পাঠানো হয় সংশোধিত ডিপিপি, যা বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, যুবকদের আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশলের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতা বৃদ্ধি, তাদের জীবনে শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি এবং বৈরী পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের মানসিকতা গড়ে তোলা। প্রশিক্ষণার্থীদের শেখানো হবে আত্মরক্ষার প্রাথমিক কৌশল, যেমন হঠাৎ আক্রমণ এড়ানোর কৌশল, শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখা, দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো, শারীরিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব যেভাবে বাড়ছে, তাতে ব্যক্তিপর্যায়ে আত্মরক্ষার দক্ষতা থাকা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করলেই চলবে না, সাধারণ মানুষকেও নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হতে হবে। বিশেষ করে নারীরা যেভাবে প্রায়ই হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাতে আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশল জানা থাকা এখন সময়ের দাবি। এ প্রকল্প প্রস্তাবনা সেই প্রয়োজন থেকেই তৈরি করা হয়েছে।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য যুবসমাজকে আত্মবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলা। প্রকল্পটির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী যুবক-যুবতীরা শুধু নিজেদের আত্মরক্ষায়ই দক্ষ হবেন না, একই সঙ্গে সমাজে সচেতন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও সাহসী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের যুবদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তাবোধ যেমন বাড়বে, তেমনি সমাজে অপরাধপ্রবণতা রোধেও এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, যা প্রশিক্ষণার্থীদের লড়াকু মনোভাব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য যুবক-যুবতীদের বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে পারেন। বিকেএসপিতে এ ধরনের প্রশিক্ষণ চালু থাকলেও মন্ত্রণালয় থেকে এর আগে বাস্তবায়ন হয়নি। এবারই প্রথম এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির পর ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এখন অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা। অনুমোদন পেলে বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হবে।’
ডিপিপিতে উল্লিখিত তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পটির আওতায় যুবক-যুবতীদের চারটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এগুলো হলো জুডো, কারাতে, শুটিং এবং তায়কোয়ান্দো। এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবক-যুবতীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, শারীরিক ভারসাম্য অর্জন, শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ, শারীরিক সক্ষমতা অর্জন, রাস্তাঘাটে চলার সময় সতর্ক থাকা, নিজের প্রতি সম্মান, লড়াকু মনোভাব তৈরি এবং লক্ষ্য ঠিক করতে সাহায্য করবে।
‘যুবদের আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নে মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রশিক্ষণের পেছনে খরচ হবে ২৩ কোটি ১০ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। আসবাব কেনাকাটায় যাবে ২ কোটি ৫১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা খরচ হবে প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসস্থান সংস্কার, যন্ত্রপাতি, যানবাহন, প্রচার ও বিজ্ঞাপন, সম্মানী ও আপ্যায়ন ভাতা, মধ্যবর্তী মূল্যায়ন এবং অন্যান্য মনিহারি খাতে।