Image description
গঠন হচ্ছে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস : নতুন নামে জেলা ও উপজেলা কমিশনার

মাঠ প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক’ ও ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ পদবি পরিবর্তন করে যথাক্রমে ‘উপজেলা কমিশনার’ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ করার জন্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুপারিশ বাস্তবায়ন করলো সরকার। এছাড়া ‘অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)’ পদবী পরিবর্তন করে ‘অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভ‚মি ব্যবস্থাপনা) করা হয়েছে। দক্ষ, জনমুখী, শিক্ষার্থী বান্ধব ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনপ্রশাসনের নানা ক্ষেত্রে প্রায় দুই শতাধিক সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বর্তমানে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোকে সরকারের পদ বলা হয়। প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্যসব ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এই সার্ভিসের অধীনে থাকবে উপসচিব থেকে সচিবের সব পদ। যদিও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত শতভাগ পদে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আসছেন। আর প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্যসব ক্যাডারের কর্মকর্তারা পরীক্ষা নিয়ে উপসচিবের শতভাগ পদে পদোন্নতির দাবি জানিয়েছেন।

সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তন, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পদবি পরিবর্তন, ১৫ বছর চাকরির পর পেনশনসহ স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার সুযোগ, বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস কমিশন গঠন, ভ‚মি রেজিষ্ট্রেশন অফিস সংস্কার, মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার, কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন, কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থাসহ সংস্কার কমিশনের ১০টি সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়ে গত রোববার মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সকল সার্ভিস থেকে মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলোর জন্য সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) গঠনের সুপারিশ করেছে সংষ্কার কমিশন। সব সার্ভিস থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে এসইএসে নিয়োগ দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সুপারিশ গুলো বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংষ্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জেলা প্রশাসক পদবি পরিবর্তন করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবি পরিবর্তন করে উপজেলা কমিশনার করার পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য সুপারিশগুলো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে বাস্তবায়ন করতে পারবে। তার আগে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে ফাইল তৈরি করে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন নিতে হবে।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন করে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এরমধ্যে শুধু পাবলিক সার্ভিস কমিশন (শিক্ষা) গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (সাধারণ) এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এখনো নিদেশনা আসেনি।

গত ৫ ফেব্রæয়ারি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। একই সঙ্গে কমিশন চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া কমিশন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে। সুপারিশে মন্ত্রণালয় ২৫টি ও অধিদপ্তর ৪৪টি করার প্রস্তাব রয়েছে। প্রতিবেদনে একটি দক্ষ, জনমুখী, শিক্ষার্থী বান্ধব ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনপ্রশাসনের নানা ক্ষেত্রে প্রায় দুই শতাধিক সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ করা হয়।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা: এদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা প্রকৃতির অভিযোগ গুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয় কমিশনের সুপারিশে। অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। এতে বলা হয়, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরবর্তীতে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকরা সহজে মামলা করার সুযোগ পাবেন। অপরদিকে, সমাজের ছোটোখাটো বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতের উপর অযৌক্তিক মামলার চাপ কমে যাবে। তবে এরূপ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী একই বিষয়ে পুনরায় আদালতে যেতে পারবেন না।

এ সুপারিশের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপনের বিষয়ে বলা হয়েছে- উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপন করা হলে সাধারণ নাগরিকরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কমিশনের অন্যান্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে ভারতের নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ ছিলো। গত অক্টোবরে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়।

শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১ মাস পূর্ণ করেছে। এই ১১ মাসে সরকার তাদের গৃহীত নানা পদক্ষেপ ও সাফল্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্তৃপক্ষ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সরকারের কার্যক্রম এবং অর্জনগুলোর একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রশাসন,গণমাধ্যম, জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সব কিছুতেই গৃহীত নানা পদক্ষেপ ও সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়। এছাড়া আগামীর পরিকল্পনা হিসেবে সব শূন্য পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ,পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি, পদোন্নতি বঞ্চিত ও অন্যান্য বঞ্চনার শিকার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গত ৮ নভেম্বর তিন মাস পূর্ণ করছে। এ তিন মাসে যে সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তার একটি সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সুপারিশে উল্লেখযোগ্য সংস্কার চাকুরি পনের বছর হলে যে কোন সরকারি কর্মচারী পেনশন সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারবেন,বিভাগীয় কমিশনার প্রশাসন ক্যাডারে সর্বোচ্চ পদসোপান, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তন, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবি পরিবর্তন। কোটা হ্রাস, মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার, কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন, নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থা, বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস কমিশন গঠন, ভ‚মি রেজিষ্ট্রেশন অফিস সংস্কার। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন করে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এরমধ্যে শুধু পাবলিক সার্ভিস কমিশন (শিক্ষা) গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (সাধারণ) এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় কিছু বলেনি। প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ভ‚মি রেজিস্ট্রেশন অফিস সংস্কারের অংশ হিসেবে এই অফিসের কার্যক্রম আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে নিয়ে ভ‚মি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে আইন ও ভ‚মি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় বসবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এসইএস গঠনের পর যেসব কর্মকর্তা বর্তমানে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিবের পদগুলোতে রয়েছেন তারা সবাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসইএসে অন্তর্ভুক্ত হবেন। সচিব, মুখ্যসচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবও স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসইএসের সদস্য হবেন। আর একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকে বাছাই করে সচিব এবং সচিবদের মধ্য থেকে মুখ্য সচিব পদে পদোন্নতির জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে।