
অ-বাণিজ্যিক কোনো শর্তে রাজী না হওয়ার সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের
আমেরিকান পণ্যকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের রফতানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমানোর আশা করছে সরকার। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরণের বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অ-বাণিজ্যিক কোনো শর্তে রাজী হবে না ঢাকা। গত রোববার বিকালে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে এক ডজনের বেশি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো ও নীতিগত সমন্বয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, বৈঠকে ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির তুলনায় ভিয়েতনাম ১২২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত রফতানি করেও শুল্কের হার ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। তাই বাংলাদেশের জন্য শুল্কের হারও এর কাছাকাছি হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। ওই কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে শুল্কবাবদ বাংলাদেশ বছরে ৬৪৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পাল্টা শুল্ক) কমাতে রাজী হলে বাংলাদেশ এসব শুল্কের পুরোটাই ছাড় দিতে রাজী হবে। তবে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন সংক্রান্ত ‘রুলস অব অরিজিন’ শর্তে বাংলাদেশ ছাড় পাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আন্তঃমন্ত্রণালয় এ সভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবসহ প্রায় এক ডজন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, আমরা খুব শিগগিরই আলোচনার জন্য যেতে চাচ্ছি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র মিটিংয়ের সময় এখনো নিশ্চিত করেনি। তাদের তো অনেক দেশের সঙ্গেই মিটিং করতে হচ্ছে। তাই তাদের প্রিপারেশন (প্রস্তুতি) নিতে সময় লাগছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তির ডকুমেন্টের প্রেক্ষাপটে এ সপ্তাহেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত পজিশন পেপার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর- ইউএসটিআরে পাঠানো হবে। তার আগে তৃতীয় রাউন্ড তথা চূড়ান্ত নেগোসিয়েশনের জন্য মিটিংয়ের সময় চেয়ে তাদের ই-মেইল করা হবে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, বাংলাদেশের মূল পজিশন পেপার আগেই পাঠানো হয়েছে। এখন চূড়ান্ত নেগোসিয়েশন (আলোচনা) শুরুর আগে আন্ত:মন্ত্রণালয় মিটিং করে আরও কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করছি। এই খসড়া পজিশন পেপার এ সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পর তাদের দেওয়া সময় অনুযায়ী মিটিংয়ে নেগোসিয়েশন করা হবে। নেগোসিয়েশনে চুক্তির বিভিন্ন শর্তে দু’পক্ষ সম্মত হলে খসড়া চুক্তি উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন ও আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে স্বাক্ষর করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে দাবিগুলো নজিরবিহীন বলে ব্যবসায়ী নেতাদের যে উদ্বেগ সে বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বলেন, ১৯৪৯ সালের পর সারাবিশ্বে এ ধরণের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ কখনও আসেনি। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কখনও এই সংকট দেখিনি। এতদিন উন্নত দেশগুলো শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত সুবিধা দিয়ে গরীব দেশগুলোকে সহায়তা করতো, এবার যুক্তরাষ্ট্র সেখানে প্রথমবারের মতো রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেছে।
কৃষি পণ্য, বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ, এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা
সভায় অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গমের পাশাপাশি সয়াবিন, বিভিন্ন তৈলবীজ, ডাল, চিনি ও বার্লি আমদানি বাড়ানোর পক্ষে সম্মতি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। যার সাথে সঙ্গতি রেখে গত রোববার সরকারিভাবে দেশটি থেকে বছরে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং কোম্পানির উড়োজাহাজ, এলএনজি, সামরিক সরঞ্জাম আমদানি বাড়ানোর পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।
মার্কিন বিনিয়োগে বাধা কমানোর উদ্যোগ
ইউএসটিআর তাদের স¤প্রতি প্রকাশিত ‘২০২৫ ন্যাশনাল ট্রেড এসটিমেট রিপোর্ট অন ফরেন ট্রেড ব্যারিয়ার্স’ প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের সরকারি কেনাকাটায় বিপুল পরিমাণ ঘুষ-দুর্নীতি ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো সরকারি দরপত্রে অংশ নিতে পারছে না, এবং বেসরকারিখাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে মুনাফা, রাজস্ব, লভ্যাংশ ও বাহ্যিক পরিশোধের (এক্সটার্নাল পেমেন্ট) জটিলতার কথাও উল্লেখ করেছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি প্রোটেকশন (আইপি) ও জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) এর আন্তর্জাতিক কনভেশন মানে না বলে অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তিতেও এসব বিষয়ে শর্তারোপ করেছে দেশটি।
সভায় শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশও পুরোপুরি আইপি প্রোটেকশন মানতে পারে না। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে এই মুহূর্তে শতভাগ আইপি প্রোটেকশন মানা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে এক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের অঙ্গীকার করবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।সরকারি কেনাকাটায় যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস সংশোধন করার পাশাপাশি জি-টু-জি ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো, এবং বাংলাদেশে ব্যবসারত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মুনাফা, রাজস্ব ও মূলধন দ্রæত ছাড় করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মার্কিন কোম্পানিগুলো কোনো বাধার সম্মুখীন হলে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে সেগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে সমাধান করা হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হবে।
ইউএসটিআরের প্রতিবেদন
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত ২ এপ্রিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের নির্বাহী আদেশের মাত্র দু’দিন আগে। ওই সময় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়, যা পরে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে দুর্নীতিকে “ব্যাপক” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও দেশে ই-প্রকিউরমেন্ট পোর্টাল চালু হয়েছে, তবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর অভিযোগ-দরপত্রের শর্তাবলি পুরনো এবং পছন্দসই দরদাতাদের সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়, ফলে ন্যায্য প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত হয়।
মার্কিন কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, বিদেশি প্রতিযোগীরা স্থানীয় অংশীদার ব্যবহার করে প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে এবং বিড রিগিং, ঘুষ এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে মার্কিন দরদাতারা নিয়মিতভাবে বঞ্চিত হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের আইন দুর্নীতিবিরোধী হলেও বাস্তবায়ন দুর্বল। পাশাপাশি, ডিজিটাল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এনক্রিপশন ভেঙে ট্রেসযোগ্যতা বাধ্যতামূলক করার নীতিকে ‘সরকারি নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কাজনক উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিভিল সোসাইটি। ২০১৫ সাল থেকে ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি বড় ব্যবসায়িক বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ইউএসটিআর প্রতিবেদন বাংলাদেশে দুর্নীতিকে “ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, দুর্নীতিবিরোধী আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দুর্বল। সরকারি ক্রয় বিধিতে সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করার প্রচেষ্টা, লাইসেন্স ও দরপত্র অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ চাওয়ার অভিযোগও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন আরও উল্লেখ করা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ দরপত্র নিশ্চিত করতে সংস্কারের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে এবং আগের সরকারের সরাসরি দরপত্র আলোচনার প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রেখেছে। তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ থেকে লাভ, লভ্যাংশ এবং পুঁজি প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এখনও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে দীর্ঘসূত্রতার সম্মুখীন হতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকতে হয়।
ইউএসটিআর বাংলাদেশের ডিজিটাল বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতিমালার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২১ সালে প্রণীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিষয়ক বিধিমালায় এনক্রিপ্টেড পরিষেবার ট্রেসযোগ্যতা (ট্র্যাক করে শনাক্ত করার সক্ষমতা) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে-যা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ আশঙ্কা করছে, এসব বিধিনিষেধের ফলে কর্তৃপক্ষের জন্য কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ এবং যেসব কোম্পানি এসব শর্ত পূরণে অক্ষম বা অনিচ্ছুক, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
তথ্য সুরক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রস্তাবিত আইন নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে, প্রতিবেদনটি ২০১৫ সাল থেকে ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের রফতানিকারকদের জন্য একটি বড় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।