Image description

মর্মান্তিক। মর্মন্তুদ। বিভীষিকাময় এক ঘটনা দেখলো দেশ। স্কুল ভবনে অকস্মাৎ আছড়ে পড়লো প্রশিক্ষণ বিমান। বিস্ফোরণ-আগুনে পুড়ে ঝরে গেল অন্তত ২০টি জীবন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে দেড় শতাধিক কচি প্রাণ। পোড়া শরীর নিয়ে শিশুদের বাঁচার আকুতি। আহত সন্তান নিয়ে অভিভাবকদের গগনবিদারী আর্তনাদ। হাসপাতালে হাসপাতালে কান্না আর আহাজারিতে সোমবারের বিকালটা হয়ে উঠেছিল এক বিভীষিকার বিকাল।

গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এফটি-৭ বিজিআই রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানের পাইলটসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের কয়েকজন ছাড়া সবাই স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থী। গুরুতর আহতদের জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালেও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। তিনদিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান স্মরণে চলমান কর্মসূচি। দেশের ইতিহাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা এটিই প্রথম। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ট্র্যাজেডির ঘটনাও বিরল। 
আহতদের চিকিৎসায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে ছুটে যান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। সেনাবাহিনী প্রধান, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী প্রধানরাও ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা উদ্ধার ও আহতদের চিকিৎসা তৎপরতা তদারকি করেন। স্থানীয় জনসাধারণ ও স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাও উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন। হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক প্রকাশ করা হয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও। আহতদের দেখতে ও চিকিৎসার খোঁজ নিতে বিভিন্ন দলের নেতারা তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ছুটে যান। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর ‘এফ-৭ বিজিআই’ফাইটার জেটটি সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়। মাইলস্টোন স্কুলের উত্তরা ক্যাম্পাসের হায়দার আলী ভবন নামের দুইতলা একাডেমিক যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয় সেখানে ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস থ্রি থেকে এইটের শিক্ষার্থীদের কোচিং হতো। এছাড়া প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাসও নেয়া হতো এ ভবনে। বেলা একটার পর ক্লাস ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ কোচিংয়ে থেকে যায়। এছাড়া অভিভাবকদেরও অনেকে ভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন। বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। অনেক দূর থেকেও সেখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। জ্বলন্ত উড়োজাহাজটির আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট। উড়োহাহাজের আগুন ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে আটকা পড়েন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীরা। দুর্ঘটনার পরপরই স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও আশপাশের লোকজন উদ্ধারে ছুটে যান। পরে যুক্ত হয় ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য বাহিনী। দুর্ঘটনাস্থল থেকে আহত ও দগ্ধদের রিকশা, ঠেলাগাড়িসহ বিভিন্ন বাহনে করে সরিয়ে নিতে দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে ঢাকা সিএমএইচ, উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে নেয়া হয় আহতদের।  সেখান থেকে দগ্ধদের অধিকাংশকে পাঠানো হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্থালে সাংবাদিকদের বলেন, তাদের কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। আইএসপিআর পরে জানায়, বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ মোট ২০ জন সেখানে মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে ঢাকা সিএমএইচ-এ নিহত ১২ জন, বার্ন ইনস্টিটিউটে ২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে ২ জন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ২ জন, ঢাকা মেডিকেলে ১ জন, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে ১ জনের লাশ ছিল।  সোমবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, রাজধানীর ৮টি হাসপাতালে ১৭১ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। রাতে জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, হাসপাতালে আহত ৮৮ জন ভর্তি আছে। এর মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন আছেন। তাদের ২৫ জনের অবস্থা গুরুতর। 

বেলা দুইটার পর দেখা যায়, বিমান দুর্ঘটনার পর উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশন থেকে সারিবদ্ধ হয়ে একের পর এম্বুলেন্স প্রবেশ করছে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, এপিবিএন সদস্যরা সকলে মিলে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। এক একটি এমু্বলেন্সে স্কুলের ভেতর থেকে আহতদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল, সিএমএইএচ, জাতীয় বার্র্নসহ বিভিন্ন হাসপাতালে। বিমান বিধ্বস্তের খবর পেয়ে অনেক অভিভাবক স্কুলের সামনে ভিড় করছেন তাদের সন্তানের খোঁজ নিতে। অনেকে ভেতরে ঢুকতে না পেরে স্কুলের গেটের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আরিফুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে সুফিয়া কামাল হলের ৭ তলার ৯ নম্বর রুমে ছিল। ওর এখন কী অবস্থা, কোথায় আছে আমরা কিছুই জানি না। বাংলা ভার্সনের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নিধির খোঁজে আসা তার বড় ভাই বলেন, যেখানে বিমানটা বিধ্বস্ত হয়েছে সেই ভবনেই আমার বোন ক্লাস করছিল। ও বাংলা ভার্সনের ৩য় শ্রেণিতে পরে। ওর রোল ১১১২। নিধি এখনো বাসায় যায়নি। আমরা সবগুলো হাসপাতাল খুঁজে দেখছি কোথাও নেই। 

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, গেট দিয়ে ঢুকে ভেতরের বাম পাশে বড় মাঠ। মাঠের সামনেই ইংরেজি ভার্সন ও নাইন থেকে ইন্টার মিডিয়েটের শিক্ষার্থীদের জন্য একের পর এক ভবন। সেখানে গতকাল অনেক শিক্ষার্থীরই পরীক্ষা চলছিল। আর মাঠের সামনে হাতের ডান পাশে ‘হায়দার আলী হল’ নামে পুরনো দুই তলা ভবন। যেখানে প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভার্সনের শিশুদের ক্লাস নেয়া হয়। ক্লাসের পর সেখানেই হয় কোচিং। বিকট শব্দে বিধ্বস্ত হয়ে ওই বিমানটি ঠিক ওই হায়দার আলী হলের সিঁড়ির নিচে ঢুকে যায়। বিমানের আগুনে মুহূর্তেই ভবনে আগুন লেগে যায়। মো. হুমায়ন কবির নামে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, আমি তখন ক্লাস টেনের রুমে ছিলাম। ওদের একটা পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যেই আমাদের ওই বিল্ডিংয়ের ওপরে বিশাল এক বিস্ফোরণের শব্দ হলো। ওই বিস্ফোরণের বিষয়টি জানতে বাইরে এসে দেখি একটি বিমান বাংলা ভার্সনের প্রাথমিকের ভবনের সিঁড়ির নিচে ঢুকে গেছে। তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। ওই সময় ক্লাসরুমে থাকা ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র দেব মিত্র বলে, প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের সকলের ওই হায়দার আলী ভবনে ক্লাস হয়। অন্যদিনের মতো কালকেও আমরা ক্লাসরুমে ছিলাম। সাড়ে ১২টায় অনেকের ছুটি হয়ে গেলে কেউ কেউ ক্লাসরুমের সামনের দোলনায় ঝুলছিল, বল নিয়ে খেলা করছিল। আর আমরা যারা বৃত্তির কোচিং করবো তারা ক্লাসরুমে বসে টিফিন খাচ্ছিলাম। এরমধ্যে হঠাৎ বিশাল একটা শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখলাম- এটা বিমান যেন সামনের ভবনের ছাদের আঘাত খেয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি আগুন আর আগুন। আমি তখন খাবার ও বইয়ের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে মাঠের দিকে চলে যাই। তখন শিক্ষকরা পাশের ভাঙা গেট দিয়ে আমাদের বেরিয়ে যেতে বলেন। আমিও তখন তাদের সঙ্গে বাইরে চলে আসি। পরে রাস্তার একজনের ফোন দিয়ে আমার বাবার নম্বরে ফোন করে জানাই। আকবর নামে স্কুলটির একজন সিকিউরিটি গার্ড বলেন, আমরা স্কুলের ভেতরেই ছিলাম। কিছু বাচ্চার ছুটি হয়েছে, যাদের অভিভাবক নিতে এসেছে তাদের বের করছিলাম। এর মধ্যেই এই ঘটনা। তিনি বলেন, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে এত জোরে শব্দ হয়েছে যে, আশপাশের মানুষ পর্যন্ত চলে এসেছে। তিনি বলেন, এই স্কুলের ওপর দিয়ে বিমানের রুট। হযরত শাহ্‌জালাল বিমান বন্দরে ওঠা-নামা করা সকল বিমানই এই স্কুলের ওপর দিয়ে যায়। তাই বিমান নিয়ে আমরা তেমন কোনো কিছু ভাবি না। কিন্তু বিমান যে এইভাবে স্কুলের ওপর পড়বে তা কখনোই চিন্তা করিনি। হাদি আলমাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমরা দেখলাম বিমানটি স্কুলের নতুন বিল্ডিয়ের সঙ্গে মনে হলো ধাক্কা খেলো। এরপরই আগুন ধরে আছড়ে পড়ে। তিনি বলেন, এখানে সব ছোট ছোট বাচ্চা। কতো বাচ্চা ছটফট করে চোখের সামনে চলে গেল কিছুই করতে পারলাম না। দিনভর উদ্ধার কাজ চালানোর পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও বিমান বাহিনীর কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে ট্রাকে করে নিয়ে যান। বিমানের আগুনে হায়দার আলী ভবনের বেশির ভাগই পুড়ে গেছে। নিচতলা-দুইতলার একাধিক শ্রেণি কক্ষের কিছু অবশিষ্ট নেই। ভবনে প্রবেশের সিঁড়ির নিচে মাটির ভেতর ঢুকে যায় বিমানের মাথা। মাইলস্টোনের মাঠে বসে উদ্ধার তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার। সবশেষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যায় তিনি বলেন, আমরা এটুকু নিশ্চিত করতে পারি যে- যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য আমরা ভীষণ রকমভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের গাফিলতি এখানে হবে না। আমরা এটাও মনে করি যে এই দুর্ঘটনার একটা ভালো রকমের তদন্ত হওয়া দরকার, সেটাও করা হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, আমরা অত্যন্ত শোকাহত যে এই ঘটনা ঘটেছে, অনেকগুলো তরুণ প্রাণ ঝরে গেছে। এই ধরনের একটা ভয়ানক দুর্ঘটনায় আমরা শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। যারা আহত হয়েছেন, তারা যেন দ্রুত সুস্থ হন, তার জন্য আমরা পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি। 

দুর্ঘটনায় পড়া এফ-৭ বিজিআই মূলত চীনের তৈরি চেংদু জে-৭ সিরিজের একটি মাল্টি-রোল জেট ফাইটার। সোভিয়েত আমলের মিগ ২১ এর উন্নত এই চীনা সংস্করণ তৈরি করেছে চেংদু এয়ারক্র্যাফ্‌ট করপোরেশন। চেংদু জে-৭ সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণ এফ-৭ বিজিআই। এক ইঞ্জিনের এ বিমানের সর্বোচ্চ গতি মাক ২.২ (শব্দের গতির ২.২ গুণ)। আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার গাইডেড বোমা ও জিপিএস গাইডেড বোমা, বাড়তি জ্বালানি ট্যাংকসহ দেড় হাজার কেজি ওজন বইতে পারে এসব জঙ্গি বিমান। এ বিমানের ককপিটে একজন বৈমানিক বসতে পারেন। কেএলজে-৬ এফ রাডার ব্যবহার করা হয় এফ-৭ বিজিআই বিমানে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এরমধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই। ২০১১ সালে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ১৬টি জেট ফাইটার কেনার চুক্তি করে এবং ২০১৩ সালে সেগুলো বিমান বাহিনীর বহরে যুক্ত হয়। ওই বছরই চেংদু এয়ারক্র্যাফ্‌ট করপোরেশন এই মডেলের উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে মহড়ার সময় বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ এমবি। ওই দুই ঘটনায় দু’জন বৈমানিক নিহত হন। 

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা এক শোকবার্তায় বলেন, এই দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মচারীসহ অন্যান্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ। তিনি বলেন, সরকার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি এবং সবধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, মাইলস্টোনের ঘটনায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হবে। এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দেশের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সকল সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। হতাহতদের জন্য দেশের সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। 

ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা
আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশুদের মা-বাবাকে আমরা কী জবাব দেবো
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, এ ঘটনায় পুরো জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। আমরা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশুদের মা-বাবাকে আমরা কী জবাব দেবো? প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমার বলার কোনো ভাষা নেই। কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আমার মতো সারা দেশের লোক আজ হতবাক। এ রকম একটা কাণ্ড হতে পারে আমরা কেউ কল্পনা করিনি, ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু এ অবিশ্বাস্য জিনিস আমাদের হঠাৎ করে গ্রহণ করতে হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের ওপর পড়লো, আগুনে পুড়ে মরলো- মা-বাবাদের আমরা কী জবাব দেবো, কী বলবো। অজানা শিশুদের মুখ সবার চোখে ভেসে উঠছে। সারা জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। শোকাহত বললে কম বলা হবে। 

তিনি আরও বলেন, এখনো লাশ আসছে হাসপাতালে। এখনো হাসপাতালে মারা যাচ্ছে। মা-বাবা খোঁজ নিচ্ছে আমার সন্তান কোথায়? তাকে আর কোনোদিন চেনা যাবে কিনা। যাদের লাশ দেখছি তার মধ্যে আমার সন্তান আছে কিনা। পৃথক করার তো কোনো উপায় নেই। এরা আমাদের সবার সন্তান। হঠাৎ করে চিরদিনের জন্য চলে গেল। আমরা তদন্ত করবো কিন্তু তদন্তে তো তারা ফিরে আসবে না। আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সকল হাসপাতালে মানুষ ছুটে আসছেন। সবার প্রতি আমাদের অনুরোধ হাসপাতালে ভিড় করবেন না। আহতদের জন্য এটি ভালো না। তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি নেই। আমরা ভিড় করে থাকলে আমাদের শরীর থেকে তাদের মধ্যে কী রোগ ছড়িয়ে পড়ে তা বলা মুশকিল। কাজেই দূরে থেকে দোয়া করেন সবাই। আমরা বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি জানাচ্ছি। 

প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের যত সন্তান আছে সবাই আপনাদের সন্তান। আমরা নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনাদের সান্ত্বনা দেয়া বিরাট ব্যাপার। আমরা সবাই আপনাদের সঙ্গে আছি। জাতির সবাই আপনাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাদের জন্য শোক দিবস ঘোষণা করেছি। সবাই মিলে আমরা তাদের স্মরণ করবো। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করবো। আজ থেকে সবাই তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবো। আল্লাহ আপনাদের শান্তি দিক। আমাদের জাতির সবাইকে যারা এ দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত সবাইকে শান্তি দিক। তাদের জন্য দেশবাসী সবাই দোয়া করছে। আল্লাহ মৃত শিশুদের জান্নাতবাসী করুক। 

প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে: মেট্রোরেলের শেষ স্টেশন ‘উত্তরা উত্তর পেরিয়ে’ গোলচত্বর। গোলচত্বরের শেষ মাথায় মেট্রোরেলের অফিস। অফিস পেরিয়ে পেছনের দিকটায় বিশাল জায়গায়জুড়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। স্কুলে যেতে ছোট ভাঙা রাস্তা। একটা প্রাইভেটকার ঢুকলে রিকশাও ঠিকমতো যেতে পারে না। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সরু ভাঙা সড়কের কারণে তাই উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। ঠিকমতো যাতায়াত করতে পারছিল না উদ্ধারকারী যানবাহনগুলো। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, প্রশিক্ষণ বিমানটি পড়ে একটি স্কুল ভবনে। ভবনটি দোতলা। সেখানে নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস হয়। দুপুর একটায় শেষ হয় ক্লাস। এরপরই অভিভাবকরা নিতে আসেন শিক্ষার্থীদের। ইংরেজি মিডিয়ামের একদল শিক্ষার্থী অপেক্ষা করছিল কোচিংয়ের জন্য। তাদের ক্লাস টাইম ছিল দেড়টায়। ভবনটিতে ১৬টি ক্লাসরুম, ৪টি শিক্ষকদের রুম রয়েছে। একটু দূরেই ক্যান্টিন। প্রতিষ্ঠানটির ওপর দিয়ে বিমান যাওয়া-আসার চিত্র নতুন নয়।

ক্যান্টিনের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল শিক্ষার্থী সাদিক ইসলাম, মিলন মৃধা, সজল খানসহ বেশ কয়েকজন। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিক বলে, আমরা ক্যান্টিন ও বিল্ডিংয়ের মাঝখানে ছিলাম। একটা বিমানের শব্দ পাই। মনে হলো, নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখি বিমানটি নিচের দিকে নামছে। স্কুল মাঠে ল্যান্ড করার চেষ্টা করছে। এরপর বিমানটি দোতলা বিল্ডিংয়ের প্রবেশপথ ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসরুমের দিকে আঘাত করে। প্রথমে কিছুটা অল্প আগুন ছিল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই বিকট শব্দ হয়। এরমধ্যে একজন বিমান থেকে প্যারাসুট দিয়ে নামে স্কুলের সুইমিং পুলের পাশে। 

সাদিক বলে, আঘাত হানার পর মনে হয়েছে বিমানে থাকা কিছু ব্লাস্ট হয়েছে। এরপর আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমরা কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দেখি বাচ্চারা দৌড়ে বেরিয়ে আসছে। অনেকের শরীরে রক্ত, পোড়া। কয়েকটা শিশুর শরীরে আগুন জ্বলছিল। এক বাচ্চার একটি হাত উড়ে গেছে। আমরা উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলেও আগুনের কারণে ভিতরে যেতে পারিনি। 

দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ আহমেদ। সে জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের কিছুটা দূরে আমাদের ক্লাস চলছিল। আমাদের ক্লাসে বিমানের শব্দ নতুন কিছু না। তবে, এবার কিছুটা জোরে শব্দ হয়েছিল। মুহূর্তেই আরও একটি বিকট শব্দ। শব্দে আমাদের বিল্ডিং কাঁপতে থাকে। আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, ধোঁয়া  উড়ছে। কিন্তু ঘটনাস্থল দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা চিৎকার করছে। বেরিয়ে ঘটনাস্থলে আসি ৫ থেকে ৬ মিনিট পর। তখন দেখি, শিক্ষার্থীরা আহতাবস্থায় ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। অনেকের শরীর-কাপড় পোড়া। কয়েকজন নিচে পড়ে ছিল। এরপর এলাকাবাসীও এগিয়ে আসে। তারা শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে দূরে নিয়ে যায়। ওই সময় সকলেই ভয় করছিল, ফের যদি বিস্ফোরণ হয়।

মাইলস্টোনের গেটের কিছুটা সামনে চা দোকানি লোকমান আলী। তিনি দোকানেই ছিলেন। বলেন, দোকানে টিভি চলছিল। হঠাৎ শব্দ শুনি। প্রথমে ভেবেছি, সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়েছে। শব্দ হওয়ার সঙ্গেই বাইরে আসি। স্কুলের ভেতর আগুন দেখি। ১০-১২ জন সেখানেই পড়ে ছিল। সবাই মিলে দৌড়ে যাই। দেখি বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে। কোথায় যাবে, না যাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেকের শরীর পোড়া। আমরা তখনও জানি না বিমান বিদ্ধস্ত হয়েছে। বাচ্চাগুলোরে উদ্ধার করে একটা ফাঁকা জায়গায় নিই। আহত কিছু বাচ্চাকে নিয়ে ডিসপেনসারিতে যাই। কিন্তু আগুনের ভিতরে যেতে পারিনি। 
দুর্ঘটনার সময় স্কুলের মাঠে ছিল অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নদী। সে বলে, আমি আম্মুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। শব্দের দিকে দৌড়ে চলে যাই। পরে তাকায় দেখি, সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। অনেকেই চিৎকার করছিল, বাঁচাও বাঁচাও বলে। কিন্তু আগুনের কারণে আমরা কাছে যেতে পারিনি।