
গোপালগঞ্জে এনসিপি’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও জেলার সর্বত্র বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা, জনমনে আতঙ্ক। আবারও বাড়ানো হয়েছে কারফিউয়ের সময়।
বুধবার (১৬ জুলাই) রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর বিকালে গোপালগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান গোটা জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। পরবর্তীতে সেটি কারফিউতে রূপ নেয়। সেদিন থেকে দফায় দফায় বাড়ানো হয় কারফিউয়ের সময়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কারফিউয়ের সময়ে পরিবর্তন আনেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘শুক্রবার (১৮ জুলাই) বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে।’ ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ কার্যকর থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল থাকে। শনিবার (১৯ জুলাই) বিকাল ৫টায় তিনি জানান, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আজ রাত ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে কারফিউয়ের সময়। এই সময়ে শুধু জাতীয় জরুরি সেবায় নিয়োজিতরা এবং যানবাহন এর আওতামুক্ত থাকবে। রবিবার (২০ জুলাই) পুনরায় বিবেচনা করে কারফিউ শিথিল অথবা সময় বাড়ানো হতে পারে।
এদিকে টানা তিন দিন পর এ দিন সকাল ৬টা থেকে কারফিউ শিথিল থাকায় কাঁচাবাজার এবং বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানে সাধারণ লোকজনের সমাগম বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ সব রুটে যান চলাচলের অনুমতি থাকলেও কোনও রুটেই যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক এবং থ্রি হুইলারের চলাচল ছিল চোখে পড়ার মতো। অবশ্য যাত্রীর অভাবে সেগুলো রাস্তার পাশেই অপেক্ষারত অবস্থায় দেখা যায়। গোপালগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জেলায় দূরপাল্লার হাতেগোনা কয়েকটি পরিবহন ছেড়ে গেলেও বেশিরভাগ পরিবহন কাউন্টারে তালা ঝুলছে।
এ বিষয়ে রিকশাচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৮০ টাকা ইনকাম হয়েছে। এই টাকা দিয়ে চাল কিনবো, না তরকারি কিনবো, সেটা বুঝতে পারতেছি না। বাড়ির সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’
ইজিবাইকচালক তমাল গাজী বলেন, ‘সকালে বের হয়েছি, রাস্তায় যাত্রী নেই বললেই চলে। এখনও গাড়ি ভাড়ার টাকা ওঠেনি। বাজারের অধিকাংশ দোকান এবং মার্কেট বন্ধ থাকায় বাইরে থেকে লোক শহরে আসছে না, তাই যাত্রীর চাপ অনেক কম।’
অন্যদিকে, শনিবারও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা এবং বুথ বন্ধ ছিল। ফলে বিপাকে পড়ছেন গ্রাহকরা। বিকাশ, নগদসহ অন্যান্য অনলাইন ব্যাংকিং সেবা চালু থাকায় দোকানগুলোতে ছিল ভিড়।
ব্যাংকিং সেবা নিতে আসা ইলেকট্রনিক্সের স্বত্বাধিকারী সোহেল খান বলেন, ‘আমাদের ইন্টারনেট এবং ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা। প্রতিনিয়তই আমাদের অনলাইন ব্যাংকিং সেবা নিতে হয়। বুথ বন্ধ থাকায় সিআরএম-এর মাধ্যমে টাকা পাঠানো যাচ্ছে না। ফলে আমাদের অর্ডারকৃত মাল আটকে আছে। এতে আমাদের প্রায় কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হবে।’
অন্য এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে। বিশেষ প্রয়োজনে তাকে টাকা পাঠানো দরকার, কিন্তু ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকায় পাঠাতে পারিনি। বিকাশে সামান্য কিছু টাকা পাঠাতে পেরেছি, বেশিরভাগ দোকানে এজেন্টের ব্যালেন্স নেই।’
তবে সকালে কাঁচাবাজারে লোকজনের সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি পণ্যের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অনেকেই কাঙ্ক্ষিত সবজি কিনতে না পেরে বাজার ছেড়েছেন। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দোকানিরা বলছেন, ‘বাইরে থেকে মাল আসছে না। তাই সব পণ্যের দাম বেশি। প্রতিটি সবজির দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।’
রিকশা, ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, থ্রি হুইলার ছাড়া আর কোনও যানবাহন চোখে পড়েনি রাস্তায়
এ বিষয়ে ফল ব্যবসায়ী নিতাই চন্দ্র বলেন, ‘আমি মঙ্গলবার রাতে এক ট্রাক আম নামিয়েছি। কিন্তু বুধবারের ঘটনার পর থেকে বাজার বন্ধ থাকায় অর্ধেকেরও বেশি আম নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।’
সবজির আড়ত ব্যবসায়ী কালিদাস সাহা বলেন, ‘বুধবারের পর থেকে কোনও তরকারি এবং সবজির গাড়ি আড়তে আসেনি। ঘরে থাকা অনেক তরকারি পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে কাঁচামরিচসহ কাঁচা তরকারি বেশি নষ্ট হয়েছে। আজ বেচাকেনা কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। কারফিউ চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
ঘটনার পরদিন সকাল থেকেই দেখা যায়, জেলা শহরের প্রধান সড়কগুলো প্রায় ফাঁকা। রিকশা, ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, থ্রি হুইলার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। তবে আজ (শনিবার) রাত ৮টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও আতঙ্ক কাটেনি।’
শনিবার বিকাল ৫টায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজ রাত ৮টা থেকে কারফিউ রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বুধবার সন্ধ্যা থেকে মাঝে মধ্যে শিথিল রেখে চলছে কারফিউ। আর এ কারণে জনজীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষের কষ্টের সীমা নেই। অনেকেই অনাহারে-অর্ধহারে জীবনযাপন করছেন।
শনিবার গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এবং গোপালগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজের বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা চালু থাকলেও অন্যান্য দিনের তুলনায় রোগীর চাপ ছিল না বললেই চলে। অনেকটা অলস সময় পার করেছেন হাসপাতালের বহির্বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক এবং কর্মচারীরা।
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আমেনা খানম নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ এবং চেকআপ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিগত কয়েকদিন বাসা থেকে বের হতে পারিনি। আজ অনেক কষ্ট করে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। গোপালগঞ্জের অবস্থা এমন থাকলে যেকোনও সময় আমাদের মতো রোগীর জীবনের শঙ্কা তৈরি হতে পারে। কারফিউ না থাকুক, গোপালগঞ্জে শান্তি ফিরে আসুক, আমরা সেটাই চাই।’
সরকারি এবং বেসরকারি চাকরিজীবীরা পড়েছেন চরম বিপদে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবী এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কাজের জন্য বের হলে পড়তে হচ্ছে বাধার মুখে। এর মধ্যে অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আটক করা হচ্ছে বাইরে বের হওয়া এসব চাকরিজীবীদের।
গোপালগঞ্জ সোনালী ব্যাংকের অফিস সহকারী লিটন মুন্সি বলেন, ‘আমার ভাই সোনালী ব্যাংক মহিলা শাখায় পিয়ন পদে কর্মরত। গতকাল বাসায় ফেরার পথে যৌথবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে পুলিশে সোপর্দ করে। আজ ব্যাংকের ম্যানেজার এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গেলেও তাকে ছাড়ানো যায়নি। তবে থানা পুলিশ তাকে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়াও এনজিওকর্মী, ইন্টারনেট ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়তই গ্রেফতার আতঙ্কে চলাফেরা করছেন।’
শনিবার বিকালে কাউফিউ শিথিলের মধ্যেও বেশিরভাগ দোকানপাট ছিল বন্ধ
বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় গোপালগঞ্জ সদর, কোটালীপাড়া ও কাশিয়ানী থানায় পুলিশের কাজে বাধা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় প্রায় তিন হাজারের অধিক লোককে আসামি করা হয়েছে বলে জানা যায়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৩০৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘শুক্রবার আমার ভাইকে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাকে ছাড়ানোর জন্য আমরা থানায় বিভিন্নভাবে চেষ্টা করি, কিন্তু তারা রাজি হচ্ছিল না। পরবর্তীতে দুই লাখ টাকা দাবি করে। আমরা অনেক কষ্ট করে এক লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘গোপালগঞ্জে এখন গ্রেফতার বাণিজ্য চরমে।’
এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গোপালগঞ্জ সদর থানায় গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজেদুর রহমান কোনও বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি প্রশাসনের কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে গোপালগঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক। এ সময় তারা বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযান অব্যাহত থাকবে। অনেক আসামি এখনও গোপালগঞ্জে লুকিয়ে আছে। তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
তাদের এই হুঁশিয়ারি এবং গ্রেফতার কার্যক্রম জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিগত কয়েকদিন যৌথ বাহিনীর টহল এবং গ্রেফতার গোপালগঞ্জবাসীকে আরও চিন্তায় ফেলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার দুই ছেলে বঙ্গবন্ধু কলেজে পড়ে। গ্রেফতারের ভয়ে আমি তাদের মামাবাড়ি অন্য জেলায় পাঠিয়ে দিয়েছি। এমন চিত্র গোপালগঞ্জের অধিকাংশ গ্রামে। গ্রেফতার আতঙ্ক এড়ানোর জন্য যে যার মতো পারছেন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দূরে থাকায় সমস্যায় পড়েছেন অন্য সদস্যরা।’
শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎপরতা বাড়তে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে। তবে কারফিউয়ের সময় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় টহলের মাত্রাও। নিচু এলাকা হওয়ায় গোপালগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা এখন জলাবদ্ধ। এসব এলাকায় অভিযান চালাতে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে নতুন করে যোগ দিয়েছেন কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর সদস্যরা।
তাদের এই অভিযান চলবে রবিবার সকাল পর্যন্ত। ইতোমধ্যে জেলার সব দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি শহরের বিভিন্ন এলাকার রোড লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে। সর্বোপরি বলতে গেলে গোপালগঞ্জ জেলাজুড়ে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা দিনরাত অপেক্ষা করছেন থানার সামনে।
উল্লেখ্য, সারা দেশে মাসব্যাপী পদযাত্রার অংশ হিসেবে বুধবার (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) রাতে তারা এটিকে ‘লং মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হিসেবে নামকরণ করেন তারা। এরপর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গোপালগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও ছাত্রলীগ (নিষিদ্ধ) নেতাকর্মীরা এটি প্রতিহতের ঘোষণা দেন। এরপরও গোপালগঞ্জের পৌর পার্কের উন্মুক্ত মঞ্চে সমাবেশ করেন এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা তাদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার কারণে এই হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে বলে মনে করেন গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষ।