
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আলোচনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ কীভাবে সামাল দেয় এবং একইসঙ্গে অন্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের ওই বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি তারা বুঝতে চায়। এজন্য গোটা বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের শূন্য শুল্ক বাজার সুবিধা দেয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যকে গড়ে ১৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। এখন চাপের কারণে যে দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) শুল্ক দিয়ে ঢুকতে হয়, সেই দেশকে যদি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় তবে যারা বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) তারা বিষয়টিকে ভালোমতো নাও নিতে পারে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও সরাসরি এ বিষয়ে কিছু না জানালেও তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
সম্ভাব্য ফলাফল
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্বল্প শুল্কে প্রবেশাধিকারের জন্য আলোচনা করছে সরকার। মোটা দাগে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদাকে সাধারণভাবে বলা যায়, ওই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য বাংলাদেশকে আমদানি বাড়াতে হবে অথবা বিনিয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পরিবর্তনের বিষয়েও ওয়াশিংটনের আগ্রহ আছে।
আমদানি বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং বিমান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। কিন্তু ইউরোপ থেকে এয়ারবাস কেনার জন্য বাংলাদেশ আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এমনকি ২০২৩ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এয়ারবাস আলোচনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমান ক্রয় করলে সেটি ইউরোপ হয়তো ভালোমতো নাও নিতে পারে।’
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের একটি গাড়ির দাম ২০ হাজার ডলার হয় এবং সেটি শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার পায়, তবে ওই গাড়ির দাম হয়তো ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা হবে। সেক্ষেত্রে জাপান থেকে বাংলাদেশের গাড়ি আমদানিতে প্রভাব পড়তে পারে।
এ বিষয়ে আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। ঢাকার মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন ধরনের বড় অবকাঠামো প্রকল্পে তারা স্বল্প সুদে অথবা অনুদানে অর্থায়ণ করে থাকে। একইসঙ্গে তারা আমাদের শূন্য শুল্কে বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা দেয়। বাংলাদেশ আমদানির মাধ্যমে তাদের কিছু অর্থ ফেরত পাঠায়। এ অবস্থায় বাংলাদেশে তাদের সবচেয়ে বড় রফতানিতে ধাক্কা লাগলে সেটি টোকিও কীভাবে নেবে সেটি বিবেচনা করা দরকার।’
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি শর্ত হচ্ছে ওই দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় বাড়াতে হবে এবং চীনের কাছ থেকে কমাতে হবে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘চায়না কনটেইনমেন্ট’ নীতি বাস্তবায়ন করতে চায়।
এ বিষয়ে সাবেক আরেকজন কূটনীতিক বলেন, “এটি অত্যন্ত জটিল একটি সমীকরণ। বাংলাদেশ সব সময় ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেছে। এখানে ‘হয় আমাকে বেছে নাও অথবা আমার শত্রুকে’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে।”
শুধু বাণিজ্য আলোচনা নয়
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা শুধুমাত্র বাণিজ্য আলোচনা নয়। এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘আমরা এখন অত্যন্ত জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র শুল্ককে ব্যবহার করে তার হেজেমনি শক্তি বজায় রাখার চেষ্ঠা করছে। এজন্য এটিকে শুধুমাত্র বাণিজ্যের লেন্স দিয়ে না দেখাই ভালো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর জন্য দরকার শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রয়াস, যাকে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা সহায়তা করবে। মোটা দাগে কূটনীতিক এবং বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার হবে এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য।’