রাজধানী ও তার চারপাশে ৪৬৬টি হটস্পটে গোয়েন্দা তালিকাভুক্ত ৯৬৯ সক্রিয় ছিনতাইকারী রয়েছে পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ঢাকার দেড় শতাধিক স্পট এখন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণও যাচ্ছে অনেকের। আতঙ্ক বেড়েছে পথচারীদের। সন্ধ্যা নামলেই এখন অনেক স্থানে লোক চলাচল কমে আসে।
পুলিশ, গণমাধ্যম ও ঢাকার চারটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সূত্র মতে, গত আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৪২৮টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আহত ৪৩৪ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এটা শুধু চিকিৎসা নেওয়াদের হিসাব। ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিদের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি।
পুলিশের ভাষ্য, অধিকাংশ ঘটনার থানায় মামলা বা জিডি হয় না। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই কোনো লিখিত অভিযোগ করেন না। খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলে কম মানুষই থানা-পুলিশ করতে যান। ফলে যে হারে ছিনতাই হয় সে তুলনায় থানায় মামলার সংখ্যা কম।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সব ক’টি গোয়েন্দা সংস্থা রাজধানীর হটস্পটের তালিকা তৈরি করেছে। এসবি তাদের রিপোর্টে বলেছে, রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য ৪৬৬টি হটস্পটে ৯৬৯ ছিনতাইকারী সক্রিয় রয়েছে যারা পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এসবি তাদের তালিকাও প্রকাশ করেছে।
গোয়েন্দাদের তৈরি হটস্পটগুলোর কিছু তালিকা আমার দেশ প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে মতিঝিল এলাকায় শাপলা চত্বর ও নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ, আরামবাগ ও তার আশপাশ, ফকিরাপুল এলাকায়ও তারা সক্রিয় রয়েছে। মতিঝিল এলাকায় কিছু ভাসমান ছিনতাইকারী রয়েছে।
সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড, কুতুবখালী খালের মুখ থেকে মাছ বাজার এলাকা। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ও জনপদের মোড়, যাত্রাবাড়ী মাছ বাজার থেকে কাঁচাবাজার এলাকা, শনিরআখড়া বাসস্ট্যান্ড, যাত্রাবাড়ী কলাপট্টি, ডেমরা সাইনবোর্ড বাসস্ট্যান্ড, ধোলাইখাল চৌরাস্তা, নাসিরউদ্দিন সরদার লেন, টং মার্কেট, বানিয়ানগর মোড়, হানিফ স্টিল মিল এলাকা, কাঠের পুল, ইকরামপুর মোড়, কলতাবাজার, জয়কালী মন্দির, কাপ্তানবাজার, বিসিসি রোডে, পোস্তগোলা ব্রিজের ঢাল, আলম মার্কেটের আশপাশেও ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
কদমতলী থানার মধ্যে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড, পাটেরবাগ পানির পাম্প ও ইটালি মার্কেটের সামনে জুরাইন সবুজবাগ ১ নম্বর গলি, গুলিস্তান, মহানগর নাট্যমঞ্চের আশপাশে, বিটিআরসি কাউন্টারের সামনে, সবুজবাগ থানায় ৪টি স্কুল-কলেজের সামনের গেট, ফুটপাত, বালুর মাঠ, বাসাবো খেলার মাঠ, বিশ্বরোডের ঢাল, মানিকনগর চৌরাস্তা, মুগদা ও যাত্রাবাড়ী রোড, মুগদা, টিটিপাড়া, মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের চারপাশে, আরামবাগ, নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে, শাপলা চত্বর, কমলাপুর রেলস্টেশন ও তার আশপাশ।
সোনারগাঁও ক্রসিংয়ের সামনে, কারওয়ানবাজার সিএ ভবনের সামনে, তেজগাঁও রেল স্টেশনের আশপাশ, ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে, লাভেঞ্চি হোটেলের সামনে, মহাখালী রেল গেটের আশপাশ, পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং সেন্টারের সামনে ও আশপাশে, দক্ষিণ বেগুনবাড়ি সেটেলমেন্ট অফিসের আশপাশে এবং সাত রাস্তার চারপাশ।
বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকা, বছিলা লাউতলা মোড়, কাটাসুর কালভার্ট ব্রিজ, হুমায়ন রোড ঢাকা ল্যাব মোড়, হুমায়ন রোড ব্লক বি, তাজমহল রোড ব্লক সি, গজনবী রোড জয় ভিরার সামনে, বছিলা এসবিপিএন গ্যারেজের সামনে, রায়েরবাজার আজিজ খান রোড, রায়েরবাজার শ্মশানঘাট রোড, মিরপুর তেজগাঁও এলাকা ।
জেনেভা ক্যাম্প ব্লক সি, মোহাম্মদপুর, শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ১ নম্বর গেটের সামনে, একতা হাউজিংয়ের সামনে, বেড়িবাঁধ ৩ রাস্তার মোড়, তাজমহল রোড পিওর মিল্ক পয়েন্ট, লালমাটিয়া বন্ধ গেট, নবীনগর হাউজিং রোড, টাউন হল জান্নাত হোটেলের সামনে।
এছাড়াও অপরাধের হার যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও স্টপেজ, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, ধানমন্ডি লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যান, গাবতলী থেকে শুরু করে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন পর্যন্ত বেড়িবাঁধ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও সংলগ্ন এলাকা, রমনা পার্ক ও পাশের রাস্তা, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, লালবাগ কেল্লার মোড়-শহীদনগর-কালুনগর, আদাবর থানা এলাকা, নীলক্ষেত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তিতুমীর কলেজ এলাকা, ঢাকা কলেজের সামনের সড়ক, মিরপুর মাজার রোড, ১০ নম্বর গোল চত্বর, বেনারসী পল্লী ও বাঙলা কলেজ এলাকা, পল্লবী।
তালিকায় আরও রয়েছে বিমানবন্দর এলাকা ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনসহ গোলচত্বর এলাকা, গুলিস্তান, শান্তিনগর, মাদারটেক, মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড, ফকিরেরপুল-আরামবাগ, সদরঘাট, তেজগাঁও রেলস্টেশন, কারওয়ানবাজার এলাকা, হাতিরঝিল, ভাটারা থানা এলাকার ৩০০ ফুট ও ১০০ ফুট সড়ক এবং উত্তরার আশকোনা ও দিয়াবাড়ী। এ ছাড়াও রাজধানীর সব ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
উত্তরা এলাকার অবস্থা আরও বেশি ভয়াবহ। সন্ধ্যার পরপর এই এলাকার সড়কগুলোতে একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এসব এলাকায় মাঝেমধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান ছাড়া পুলিশের কোনো টহল নেই বললেই চলে। এখানকার ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগই গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকার মাদকসেবী। অপরাধ করেই তারা আবার নিজ এলাকায় ফিরে যায়।
বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত অপরাধের হার সবচেয়ে বেশি। এখানে একাধিক টানা পার্টি ছুরি ও সুইচ গিয়ার চাকু হাতে সক্রিয় থাকে। দিনে থাকে মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি ও পকেটমার। প্রতিদিন এই এলাকায় গড়ে ১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝামেলা এড়িয়ে চলতে ভুক্তভোগীরা থানায় যান না।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর দৈনিক আমার দেশকে বলেছেন, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চলছে। নতুন করে মাঠপর্যায়ের অভিযান আরও জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
এসবির রিপোর্ট সম্পর্কে এখনো কিছু জানিনা। তবে ডিএমপির ডিবি পুলিশ তাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্সসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়েই আমরা অপরাধ সম্পর্কে এনালাইসিস করে থাকি। অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নজরদারি করা হয়। আর হঠাৎ করে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। যেমন সম্প্রতি খুনের অপরাধও বেড়ে গিয়েছিল সেগুলোও আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি। এখন কমে গেছে। ছিনতাইয়ের বিষয়টাও নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।