Image description

সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামলীর একটি ছিনতাই আলোড়ন সৃষ্টি করে দেশজুড়ে। চাপাতি ধরে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাগ-মোবাইলের পাশাপাশি খুলে নেওয়া হয় গেঞ্জি ও জুতাও! এ ছিনতাইয়ের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মিলেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ছিনতাইয়ের এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কবির, আল আমিন ও আসলাম নামে তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। আসলাম ও আল আমিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। আর কবির এই ছিনতাইকারী চক্রের ‘মূলহোতা’। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাই চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালামাল বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রিও করতে হয় ছিনতাই চক্রের মূলহোতাদের কাছে। সব মিলিয়ে দেওয়া প্যাকেজ।

 

দাদনে ‘পুনর্জন্ম’ ছিনতাইকারীর

যদি কোনো ছিনতাইকারী গ্রেফতারও হয় তখন দাদন (ব্যবসার জন্য অগ্রিম টাকা ধার, সাধারণত সুদসহ টাকা ধার দেওয়ার জন্য বেশি পরিচিত) দেয় চক্রটি। যাতে ছিনতাইকারী আসামি আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসতে পারেন। এতকাল জেলেসহ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে দাদন শব্দটি পরিচিত থাকলেও ছিনতাইকারী ছাড়াতেও দাদন দেওয়ার বিষয়টি অভিনব। এবং এই দাদন নিয়েই জামিনে বেরিয়ে এসে যেন পুনর্জন্ম হয় চক্রের সদস্যদের। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

এমন ছিনতাই চক্র ঢাকায় প্রথম। যারা অগ্রিম চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ছিনতাই করায়। ছিনতাই শেষে মালামাল আবার চক্রের মূলহোতাদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। এছাড়া কোনো সদস্য গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে জামিনের বিষয়েও টাকা-পয়সা অগ্রিম দেয় চক্রটি।- গোয়েন্দা-তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রাকিব খান

ডিবি সূত্র বলছে, এমন দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী চক্র এই প্রথম চিহ্নিত হয়েছে। যারা ছিনতাইয়ের জন্য চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া দেয়।

 

গত ১১ জুলাই শিমিয়ন ত্রিপুরা (৩০) নামে এক ব্যক্তি রাজধানীর শ্যামলীতে সর্বস্ব ছিনতাইয়ের শিকার হন। এই ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়।

দাদনে ‘পুনর্জন্ম’ ছিনতাইকারীর

শ্যামলীতে যেভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা

শিমিয়ন ত্রিপুরা (৩০) ধামরাইয়ে একমি ল্যাবরেটরিতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত। তার শ্যামলী ভাড়া বাসা থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টার মধ্যে বেরিয়ে যান। ঘটনার দিন ১১ জুলাইও তিনি বেরিয়েছিলেন বাসা থেকে। হেঁটে শ্যামলীর মূল সড়কে যাওয়ার পথে তিনজন ছিনতাইকারী একটি মোটরসাইকেলে এসে তাকে ধারালো চাপাতি ধরে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে কাঁধে থাকা ব্যাগ, মানিব্যাগ, টি-শার্ট, মোবাইল ও জুতা খুলে নেয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন তিনি।

ঘটনাটির পর ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। এরপর একে একে রহস্য উন্মোচিত হয়।

ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, এ ছিনতাইয়ের ঘটনায় সরাসরি জড়িত তিনজন। তাদের মধ্যে দুজন আল আমিন ও আসলামকে এবং ছিনতাই চক্রের মূলহোতা কবিরকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার আল আমিন ও আসলামের বিরুদ্ধে ১৭/১৮টি করে মামলা আছে। ছিনতাইয়ে সরাসরি জড়িত পারভেজ নামে একজনকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলমান। এছাড়া এ চক্রের আরেকজন হোতা আছে, তার নাম জহির। তাকেও গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

দাদনে ‘পুনর্জন্ম’ ছিনতাইকারীর

যেভাবে ছিনতাই চক্রের সন্ধান মেলে

ডিবি জানায়, শ্যামলীতে ছিনতাইকারী তিনজনের প্রত্যেকের মুখে মাস্ক ও মাথায় হেলমেট ছিল। এ কারণে তাদের শনাক্তে বেগ পেতে হয়েছে। এজন্য মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটের সূত্র ধরে শনাক্তের চেষ্টা করে ডিবি।

ঘটনাটি শ্যামলীর দুই নম্বর সড়কের মেরিগোল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। পরবর্তীসময়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজটি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। এরপর সিসি ক্যামেরায় মোটরসাইকেলটি দেখে শনাক্ত করা হয় ছিনতাইকারীদের।

চক্রের নেতৃত্বে আপন দুই ভাই 

চক্রটি বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করতো। কিন্তু তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না। শ্যামলীতে ছিনতাইয়ের পর তাদের শনাক্ত করা হয়। ছিনতাই চক্রের মূলহোতা আপন দুই ভাই জহির ও কবির। এর মধ্যে কবির গ্রেফতার হলেও জহিরকে গ্রেফতার করা যায়নি। কবিরের কাজ টাকা-পয়সা নিয়ন্ত্রণ করা। অগ্রিম কোনো টাকা লাগলে সেটা কবির বণ্টন করতেন। পরে ছিনতাই করে ধারের টাকা পরিশোধ করতেন চক্রের সদস্যরা। কোথায় কোথায় ছিনতাই হবে, চাপাতি কতটি লাগবে এবং কোন মোটরসাইকেল দিতে হবে সে কাজ ছিল জহিরের। এ চক্রের কাছে একাধিক মোটরসাইকেল রয়েছে, যেগুলো শুধু ছিনতাইয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।

দাদনে ‘পুনর্জন্ম’ ছিনতাইকারীর

মূলহোতা জহির ও কবির কখনোই মাঠে গিয়ে ছিনতাই করে না। তারা ছিনতাই চক্র দেখভাল করতেন। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া পরিশোধ হয় ছিনতাইয়ের পর

চাপাতি ও মোটরসাইকেলের ভাড়া পূর্বনির্ধারিত নয়। ছিনতাই করার পর মালামাল কেমন পেয়েছে তার ওপর নির্ধারণ করে ভাড়া পরিশোধ করা লাগে। ছিনতাইয়ের জন্য চাপাতি ভাড়া নিলেও সারারাত ছিনতাইকারীরা যে ছিনতাই করবে সেগুলোর মালামাল জহিরের কাছে বিক্রি করা বাধ্যতামূলক। অন্য কোথাও ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রি করতে পারে না চক্রের সদস্যরা। সেখান থেকে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো জায়গায় চাপাতি-মোটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ছিনতাই করাতো চক্রটি।

গ্রেফতার হলে টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করে চক্র

ছিনতাই করতে গিয়ে যদি কোনো ছিনতাইকারী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কারাগারে যায় সেখানে যাবতীয় খরচ বহন করে চক্রটি। টাকা দেওয়ার কাজে কবির সরাসরি জড়িত ছিল। জামিন পেতে যে খরচ হয় সেই টাকা বিনামূল্যে দেওয়া হয় না। দাদন হিসেবে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়। জামিন পেয়ে বেরিয়ে ছিনতাই করে সেই দাদনের টাকাও পরিশোধ করতে হয় চক্রের সদস্যদের।

দাদনে ‘পুনর্জন্ম’ ছিনতাইকারীর

এ বিষয়ে গোয়েন্দা-তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রাকিব খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুর্ধর্ষ এ ছিনতাই চক্রের রহস্য উন্মোচনে ডিবির বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এমন ছিনতাই চক্র ঢাকায় প্রথম। যারা অগ্রিম চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ছিনতাই করায়। ছিনতাই শেষে মালামাল আবার চক্রের মূলহোতাদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। এছাড়া কোনো সদস্য গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে জামিনের বিষয়েও টাকা-পয়সা অগ্রিম দেয় চক্রটি। এজন্য এ চক্রে অনেক সদস্য রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ছিনতাই চক্রের রহস্য উন্মোচন হয়েছে, চক্রের সব সদস্যকে আইনের আওতায় আনতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলমান। আশা করি শিগগির সবাইকে গ্রেফতার করা হবে।’

ডিবির যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার প্রত্যেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আসামি শনাক্তের পর গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন একটি দুর্ধর্ষ চক্রের সব সদস্যকে গ্রেফতার করা গেলে ঢাকা শহরে ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।’