Image description

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের হয়। জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তাদের পাশে থাকা শিক্ষকদের একজন অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) এ অধ্যাপকের সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ, পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের সমর্থন ছিল উল্লেখ করার মতো। আগামী ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছেন এ অধ্যাপক। পাশাপাশি কথা বলছেন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানান দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন ইন্টার্ন নিশাত তাসনিম জেসিকা

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে আপনার সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল, আন্দোলনকারীদের সমর্থন দিয়েছেন। সে দিনগুলো কেমন ছিল?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: যখন ছাত্র ছিলাম, তখন বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি, তখনও প্রথম থেকেই বিভিন্ন সরকারের অন্যায়–অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছি। কখনো লিখে, কখনো বলে, কখনো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মিছিল করে প্রতিবাদ করেছি।

ন্যায্যতার জায়গা থেকে, বিবেকবোধের জায়গা থেকে মূলত প্রতিবাদগুলো করেছি। শিক্ষক হিসেবেও করেছি—কারণ মনে হয়েছে আমার দায়বদ্ধতা আছে। এখন পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন করেছি, তার মধ্যে অন্যতম স্মরণীয় হলো ২৪-এর আন্দোলনটা—বিশেষ করে জুলাই মাসের প্রথম থেকে আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত। এ আন্দোলনে আমি অনেক কিছু শিখেছি, বিশেষ করে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পেরেছি। তবে বলব—মূল আন্দোলনটা করেছে শিক্ষার্থীরাই। আমি শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছি।

একপর্যায়ে এ আন্দোলন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল না—ধীরে ধীরে শিক্ষকদেরও বড় অংশ যুক্ত হয়েছেন। পরে দেখা গেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। জনতা বলতে সাধারণ জনতাও—বাবা, মা, ভাই, বোন, রিকশাচালক—সবাই রাস্তায় নেমেছিলেন। বিশেষ করে ঢাকায় ব্যাপকভাবে এ দৃশ্য দেখেছি। সমাজের কোনো গোষ্ঠী বাকি ছিল না। সবার অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। তবে এর মধ্যে দুঃখজনক কিছু বিষয় আছে—অনেকে শহীদ হয়েছেন, কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন—যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

একটা আন্দোলনকে সফল করতে যে আত্মত্যাগ দরকার, সেটা সবাই দিয়েছে—প্রাণ দিয়ে, অর্থ দিয়ে, জায়গা দিয়ে, শারীরিক শ্রম দিয়ে, বুদ্ধি–পরামর্শ দিয়ে। তবে এর উল্টো গোষ্ঠীও দেখেছি—যারা অন্যায়কে জাস্টিফাই করেছে। নিপীড়ন চালিয়েছে, শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছে। এটা খুব বেদনাদায়ক—কারণ তারাও তো আমাদের দেশেরই মানুষ।

অনেকে চুপ ছিলেন, কোনো পক্ষ নেননি—কিন্তু পরে দাবি করেছেন যে, তারা আন্দোলনে ছিলেন। কেউ কেউ পালিয়েও গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রীর পরিণতি হলো পালিয়ে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রী পালানোর দুই–চার দিন আগেও যেভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে হত্যার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, নিপীড়ন চালাচ্ছিলেন—দেখে বোঝা যায়নি যে পালাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার দলের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে অরক্ষিত রেখে পালালেন! এটা কাপুরুষতা ছাড়া কিছু নয়।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: গত ১৬-১৭ বছরের শেখ হাসিনার শাসনকে কীভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: তিনি ১৭ বছরে যা করেছেন—গুম, হত্যা, নিপীড়ন, অন্যায়—সবই এক জালিম শাসকের পরিচয়। চাকরিতে ভিন্ন মতের লোককে জায়গা দেননি, প্রমোশন দেননি। আমার নিজের ক্ষেত্রেও প্রমোশন হয়নি। দলীয়করণ, নিপীড়ন, দুর্নীতি—সবই ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন যে, সরকারি পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক! অথচ তিনি অনুতপ্ত হওয়ার বদলে গর্ব করছিলেন। মানুষ কি বোকা যে অনুতপ্ততা আর গর্বের পার্থক্য বোঝে না?

তখনও কিছু কবি, সাহিত্যিক, পরিচালক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী গান গেয়ে বলেছে—‘আপা আপনাকে আবার চাই!’ নির্বাচনের সময় ডাক্তার কামাল হোসেনকে দিয়ে অন্যদের ডেকে এনে ৬–৭ টা শিট কেড়ে নেওয়া—এটা কি সুষ্ঠু নির্বাচন? এ অবিচারেরই ফল যা হয়েছে। উনি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রাখলে এমন হতো না। এখন পাশের দেশে বসে উস্কানি দিচ্ছেন।

৫ আগস্টের পর সরকার ছিল না—তবুও ছাত্ররা হিন্দুদের বাড়ি মন্দির রক্ষা করেছে, ট্র্যাফিক সামলেছে—চমৎকার কাজ করেছে। ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙা উচিত হয়নি—ওটা মিউজিয়াম হতে পারত। উনি উস্কানি না দিলে ধানমণ্ডি ৩২ ভাঙা হতো না। এটা উনারই ভুল। আরও কিছু ভাঙচুরও হয়েছে—যা দুঃখজনক।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাইয়ে আকাঙ্ক্ষা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কতটুকু বাস্তবায়িত হতে পারে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশেপাশের লোকদের নিয়ে সরকার গঠন করলেন। নিজের এলাকায় কে ছিল, কে তার এনজিওতে ছিল, এসব দেখে পদ দিলেন। ফলে দিন শেষে আবারো প্যাচ থেকে গেল। স্বাভাবিকভাবে মেধার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়ার বিষয়টা এখনো আমরা দেখি না। তিনি এমন কিছু করেছেন যা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।

উপদেষ্টারা হেলিকপ্টারে উড়ে বেড়ান, লাল গালিচায় সংবর্ধনা নেন—এগুলো কি জুলাইয়ের স্পিরিট? দুর্নীতি দমনের নামে যারা এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ নিজেরাই দুর্নীতি করেছেন—প্রমাণসহ অভিযোগ উঠেছে। আমরা তো এমন চাইনি! এ সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—সেখানে চরম ব্যর্থ। দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল সংস্কার ও বিচার নিশ্চিত করা—সেখানে চরম ব্যর্থ।

যারা অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি দিতে হবে—সবাইকে কেন আসামি বানাবেন? এটা অন্যায় নয়? আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলেন—তারা কি ফিরতে পারবে না? জামায়াতকেও তো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল—তারা তো আবার প্রায় রাজত্ব চালাচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে ঠিকই, তবে অন্যায়ের ট্যাগ লাগিয়ে দোষারোপ করাটাও অন্যায়। সরকারকে সব দলের সাথে বসে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে।

নির্বাচনের তারিখ সব দলের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা নিয়ম। ড. ইউনূস যা করলেন তা বিভ্রান্তি ছড়াল। দেশ চালাবে রাজনৈতিক দলগুলো। ছাত্রদের মধ্যেই বিভাজন হয়েছে। তারা রাজনৈতিক দল বানিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ছাত্ররা যদি এক থাকত, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল এনে নির্বাচন করাত, আজকের বাংলাদেশ সুন্দর হতে পারত। এখনও আমরা অরাজকতার মধ্যে অনিশ্চিতভাবে জীবন যাপন করছি।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর আলোচনা একসময় বেশ জোরেশোরে চলেছিল। সেটার প্রয়োজন আছে মনে করেন?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: শিক্ষকদের যদি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করা হয়—তাহলে শিক্ষক কোথায় চাকরি করছেন সেটা নয়, শিক্ষককে বেতন দেওয়া হবে তার সক্ষমতা অনুযায়ী। শিক্ষকের ডিগ্রির ভিত্তিতে এবং তিনি কী মানের শিক্ষক, সেটা অনুযায়ী। অনেকে ভালো ডিগ্রি নিয়েও ভালো শিক্ষক হতে পারেন না বা ভালো পড়াতে পারেন না। আবার অনেকে হয়তো শুধু ইন্টারমিডিয়েট পাস বা বিএসসি কমপ্লিট করেছেন, কিন্তু এক্সিলেন্ট পড়ান।

সার্টিফিকেট দেখার পাশাপাশি তার দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীর মূল্যায়নও আমরা দেখব—তারপর বেতন নির্ধারণ করব। তাছাড়া, স্কুলের টিচার ছোট টিচার, কলেজের টিচার আরেকটু বড় টিচার, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার পণ্ডিত—এই ট্যাবুটা ভাঙতে হবে। মেধাবীরা বা যোগ্যরা যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে চান, যাবেন—তিনি যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন পাবেন।

বেতন কাঠামোটা এমনভাবে তৈরি করা দরকার যাতে যার যেখানে পছন্দ সে সেখানে ইচ্ছামতো চাকরি করতে পারে। বেতন কাঠামো ঠিক থাকলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে হবে। কী করলে তারা আসবেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাইলে এই ক্যাটাগরি মানতে হবে।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক আলোচনা-বিবেচনা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতির এ গতানুগতিক ধারা কতটুকু যৌক্তিক?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: শিক্ষক তো শিক্ষকই—তার আবার রাজনৈতিক দল কীসের! তিনি বিএনপি, জামায়াত বা আওয়ামী লীগ করুন, কিন্তু যা জাতির জন্য ভালো তা-ই বলবেন, কোনো দলের ভালোকে কেন বলবেন? এই যে গত ১৬–১৭ বছরের অসুস্থ চর্চার কারণে শিক্ষকদের লোভ দেখিয়ে নীল দল–সাদা দল বানিয়ে তাদের দিয়ে সবকিছু কন্ট্রোল করছে।

অদক্ষ কোনো শিক্ষককে কাজে লাগায় না। শিক্ষকরাও তো মানুষ, তারাও লোভী হয়ে পড়ে—কারণ বেতন কাঠামো কম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা—সব জায়গাতেই শিক্ষকদের বেতন কম, তাই শিক্ষকরা ভাবে—যদি এখানে যাই, কিছু টাকা–পয়সা ইনকাম হবে। অর্থাৎ লোভের কাছে বেশিরভাগ শিক্ষক আত্মসমর্পণ করে ফেলেন।

কেউ যখন লোভের কাছে বা কোনো দলের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেন, তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না—তিনি আর বুদ্ধিজীবী থাকেন না। একজন শিক্ষক চাইলে মতামত দেবেন, যুক্তি দেবেন—এ ধরনের বাজে কালচার ভবিষ্যতে আমরা চাই না।

শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের ফোরাম থাকবে—তারা গবেষণা করবেন, সেমিনার করবেন, সভা করবেন—একবার হয়তো এক পক্ষের হয়ে কথা বলবেন, অন্য সময় অন্য পক্ষের হয়েও কথা বলবেন। একাডেমিক ফ্রিডম শিক্ষকদের থাকতে হবে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা রাজনীতি অবশ্যই করবেন—এটা তাদের অধিকার। তবে এই লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতি আমরা চাই না। শিক্ষকদের কথা বলার অধিকার দিতে হবে।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: 
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।