
৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কের চাপ এড়াতে বাণিজ্য ও অবাণিজ্য-সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে চাইছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আগামী রোববার মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরে (ইউএসটিআর) বাংলাদেশের চূড়ান্ত অবস্থানপত্র পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। এরপর বাংলাদেশের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু সাড়া দেয়, তার ওপর নির্ভর করছে দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ভাগ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য শুল্ক চুক্তি নিয়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিপ্রায় অনুযায়ী ৩১ জুলাই চুক্তি করার শেষ সময়। এর মধ্যেই বাংলাদেশকে ইউএসটিআরের সঙ্গে তৃতীয় ও চূড়ান্ত দফার আলোচনায় বসতে হবে।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আগামী রোববারের মধ্যে আমরা ইউএসটিআরের কাছে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র দেব। সেটি আমলে নিয়ে ইউএসটিআর বাংলাদেশকে ফের বৈঠকের আহ্বান জানাবে, যার শিডিউল অনুযায়ী বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন রওনা হবে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইউএসটিআর থেকে সম্ভাব্য বৈঠকের সময়সূচি পায়নি বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ২২ জুলাই ওয়াশিংটনে রওনা হতে পারে। সে জন্য ফ্লাইটের টিকিট বুকিং দেওয়া হয়েছে। তার আগে আগামীকাল শনিবারের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সম্মতির ভিত্তিতে ঢাকার অবস্থানপত্র চূড়ান্ত হবে।
কী থাকছে বাংলাদেশের চূড়ান্ত অবস্থানপত্রে—সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাতে রাজি হননি কর্মকর্তারা। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ অনেক বিষয়ে ছাড় দিতে প্রস্তুত, তা চূড়ান্ত অবস্থানপত্রে জানিয়ে দেওয়া হবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মূল দাবি, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, দেশটির কিছু পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় কোনো সীমারেখা না টানা। মার্কিনিদের এই অভিপ্রায় পূরণে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে সমতাভিত্তিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে পুরোপুরি একমত হয়েছে ঢাকা। এর জন্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বিদ্যমান সম্ভাব্য সব সুযোগ কাজে লাগাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিজপণ্য গম, তুলা, এলএনজি, রাসায়নিক সামগ্রী, মূলধনি যন্ত্রপাতি, বোয়িং বিমান এবং সামরিক সরঞ্জামসহ অন্যান্য আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। পাশাপাশি দেশটিকে শতভাগ কিংবা এর কাছাকাছি হিসেবের পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়েও অনেকটা ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে, যার অনুপাত আলোচনার টেবিলে দর-কষাকষির মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে। এ ছাড়া মার্কিন উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের মোকাবিলা করছে এমন সব অশুল্ক বাধা তুলে দেওয়ারও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি থাকছে বাংলাদেশের চূড়ান্ত অবস্থানপত্রে। আলোচিত এই শুল্ক চুক্তির বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের আবদার এখানেই থেমে নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) রুলস অনুযায়ী, আলোচনার টেবিলে দর-কষাকষির মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব, এমন সব বিষয়েও বাংলাদেশের অবস্থানপত্রে আইনের বিভিন্ন ধারা ও অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূরক নোট জুড়ে দেওয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনুযায়ী। এ ছাড়া অবাণিজ্য-সংক্রান্ত বাকি স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরুর আগেই একটি নন-ডিসক্লজার অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ চুক্তির আওতায় মার্কিন শর্তাবলি ও দাবি-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ই প্রকাশ না করার শর্ত রয়েছে। ফলে চুক্তিতে কী আছে, সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিভাগের এমন কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘চুক্তির প্রশ্নে মার্কিন দাবি ও শর্তের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় স্পষ্ট। একটি বাণিজ্য-সংক্রান্ত ইস্যু, অন্যটি অবাণিজ্য-সংক্রান্ত। আমরা বাণিজ্য ইস্যুগুলোর বিষয়ে সমাধানে পৌঁছে গেছি। কিন্তু অবাণিজ্য-সংক্রান্ত ইস্যুগুলোর বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, যা আমরা ইতিবাচক-নেতিবাচক—উভয়ই যুক্ত করে সারসংক্ষেপ আকারে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মতামতের জন্য পাঠানোর সুপারিশ করেছি। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসবে, সেগুলোই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার চূড়ান্ত অবস্থানপত্রে অন্তর্ভুক্ত করবে। যার ওপর বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে চূড়ান্ত নেগোসিয়েশনের টেবিলে বসবে।’
দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবাণিজ্য-সংক্রান্ত বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলতে হবে। তার মানে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগ-সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, তা অন্য কোনো দেশকে না দেওয়ার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশ যেন চীনের প্রতি অতিমাত্রার আমদানিনির্ভরতা কমায়, সে শর্তও রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার জিএসপি স্কিমে বরাবরই প্রাধান্য পেয়ে আসছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ণ, মানবাধিকার, সুশাসন এবং শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতের বিষয়গুলো। সেখানে এবার আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে একটি ফ্রেমওয়ার্ক গঠনের বিষয়ও নতুন করে যুক্ত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাজিদ হোসেন বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পুরো প্রক্রিয়াটি অনিশ্চয়তায় ঢাকা। বাংলাদেশ শুরুতেই জোরালোভাবে অবস্থান জানাতে পারেনি, ফলে এখন সময় হারানোর সুযোগ নেই। অন্য প্রতিযোগীরা যদি ছাড় পায়, আর বাংলাদেশ না পারে, তাহলে চাপ আরও বাড়বে।’
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১৬-১৯ শতাংশ শুল্কে পণ্য রপ্তানি হয়। নতুন হার কার্যকর হলে তা ৫১-৫৪ শতাংশে দাঁড়াবে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, ‘এই বাড়তি শুল্ক যোগ হলে মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনেক কারখানা টিকতে পারবে না, কর্মসংস্থান মার খাবে। সরকারের উচিত আলোচনার টেবিলে দর-কষাকষিতে সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দেখানোর।