Image description

ঢাকায় যখন জুলাই আন্দোলনের ঢেউ বইতে শুরু করে, তখন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখছিলেন শেরপুরের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান আতিক। পারিবারিক বাধার কারণে রাজধানীতে গিয়ে সরাসরি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না থাকলেও অন্তর দিয়ে আন্দোলনের সঙ্গেই ছিলেন তিনি।

১৫ জুলাই জানতে পারেন, শেরপুর শহরেও হবে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডায় সিদ্ধান্ত নেন ১৭ জুলাই সকলে একসঙ্গে শেরপুর শহরে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেরপুরের সংগঠকরা জানান, ১৭ জুলাই বিকাল ৩টায় শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে শুরু হবে বিক্ষোভ। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেন সবাই।

১৭ জুলাই (বুধবার) দুপুর দুইটার দিকে স্থানীয় ঝগড়ারচর বাজারে একত্রিত হতে থাকেন আতিক, তার ছোট ভাই সজীব, বন্ধু হানিফ, ফারুক, আরাফাত, সিহান, হাবিবসহ আরও অনেকে। ২টা ২০ মিনিটে তারা একটি মিশুক অটোতে চেপে রওনা দেন শেরপুর শহরের দিকে। উদ্দেশ্য মেধা ও ন্যায়ের দাবিতে কণ্ঠ মেলানো।

কিন্তু মাঝপথেই সংগঠকদের বার্তা আসে শেরপুর সরকারি কলেজে না গিয়ে মাইসাহেবা জামে মসজিদে জমায়েত হতে। কারণ কলেজ চত্বরে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ।

বিকাল ৩টায় শেরপুর পৌঁছে মসজিদে অবস্থান নেন তারা। একে একে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। কিছুক্ষণ পর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজপথে বের হওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক তখনই কলেজ গেটে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ‘রাজাকার জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে।

আন্দোলনকারীরাও পাল্টা স্লোগান দেন ‘ভুয়া ভুয়া’, ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!’ ‘কোটা না, মেধা! মেধা! মেধা!’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে শহরের রাজপথ।

কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মিছিল যখন চকবাজার এলাকায় পৌঁছায়, ছাত্রলীগ তাদের পথরোধ করে। পুলিশ পরামর্শ দেয় শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে নিউমার্কেটমুখী হতে। সে পথ ধরেই এগোতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ছাত্রলীগ ফের তাদের বাধা দেয়। পুলিশ তখন নির্দেশ দেয়, শিক্ষার্থীরা যেন থানার মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখানে দাঁড়িয়ে আবারও রাজপথে গর্জে ওঠে হাজারো শিক্ষার্থীর কণ্ঠ।

হঠাৎ করেই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু হয়। পুলিশের ছোড়া ফাঁকা গুলির শব্দে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কেউ প্রাণ বাঁচাতে দোকানে, কেউবা বাসাবাড়িতে আশ্রয় নেন। আতিক ছোট ভাই সজীবকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় নেন বাকরাসার এক বন্ধুর মেসে।

সেখান থেকে সজীবকে বাসায় পাঠিয়ে আতিক খোঁজখবর নিতে থাকেন বন্ধুদের। জানতে পারেন ফারুক ও হানিফ বাসায় ঢুকতে পেরেছিল, কিন্তু ছাত্রলীগ অস্ত্র হাতে তাদের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এক ঘণ্টা আতঙ্কে আটকে থাকার পর বাড়ির মালিকের সহায়তায় পেছনের গলি দিয়ে তারা ছাত্রাবাসে ফেরে।

আরাফাতও নিরাপদে ফিরে আসে। ফিরে এসে সে জানায়, ছাত্রলীগের ছোড়া ইটের আঘাতে তার পাশের এক বড় ভাইয়ের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছিল। সেই সময় আরাফাত যখন তার মাথা বাঁধতে চায়, তখন সেই ভাই বলেন, ‘সমস্যা নাই, রক্ত ঝরুক; তবুও কোটা মুক্তি পাক।’

সন্ধ্যায় আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলে আতিক ও আরাফাত সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি ফিরে যাবেন। কারণ পরদিন ঢাকায় আবার আন্দোলনের ডাক রয়েছে। হানিফ ও ফারুক ছাত্রাবাসেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই রাতেই ঘটে নতুন বিপর্যয়।

ভোরের আলো ফোটার আগেই খবর আসে পুলিশ হানিফ ও ফারুককে রাতেই গ্রেপ্তার করেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ, চলছে শুধু ব্রডব্যান্ড।

আতিক তড়িঘড়ি করে হানিফের মায়ের সঙ্গে রওনা দেন শেরপুর শহরের দিকে। ছাত্রাবাসে গিয়ে নিশ্চিত হন, সত্যিই তাদের তুলে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়ে দেখতে পান, একটি সেলে বসে আছে হানিফ ও ফারুক চিন্তায় মুখ ভার। তাদের দেখে হানিফ বলে ওঠে, ‘তুই কেন এসেছিস? তোকে পুলিশ ধরবে। আন্দোলনের ভিডিও দেখে ধরছে।’

চোখের জল গোপন করে আতিক ফারুকের কাছ থেকে রুমের চাবি নেয়। তখন এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘অনেক কথা বলছেন, এখন যান। ওদের কোর্টে চালান করব।’ 

এসআই-এর রুমে গিয়ে আতিক ও হানিফের মা বলেন, ‘স্যার, ওরা শিক্ষার্থী, সামনে পরীক্ষা আছে।’ কিন্তু উত্তর আসে, ‘পরীক্ষা থাকলে আন্দোলনে আসছে কেন?’ থানার গেট পেরিয়ে হতাশা আর অশ্রু নিয়ে ফিরে যান তারা। ছাত্রাবাসে গিয়ে খুঁজে বের করেন হানিফ-ফারুকের মোবাইল, যা তারা আগেই লুকিয়ে রেখেছিল।

সমাধানের পথ না পেয়ে হানিফের মা আবারও থানায় যান। এদিকে ছাত্রাবাসের খালা সতর্ক করে দেন আতিককে, ‘বাইরে যাইয়েন না, পুলিশ আর ছাত্রলীগ ঘুরতেছে।’চরম আতঙ্কে মুহ্যমান আতিক নিজেকে দোষ দিতে থাকেন কেন তাদের শেরপুরে রেখে এলেন?

সন্ধ্যায় হানিফের মা ফোনে বলেন, ‘তুমি বাবা বাসায় ফিরে যাও। এক ছেলে বিপদে, আরেক ছেলেকে বিপদে ফেলতে চাই না।’ বাধ্য হয়ে বাসায় ফেরেন আতিক। সারা রাত ফোনে যোগাযোগ চালিয়ে যান।

রাত গভীর হলে আসে সুখবর পুলিশ মুচলেকা নিয়ে হানিফ ও ফারুককে ছেড়ে দিয়েছে। আতিক আনন্দে বলে ওঠেন, আলহামদুলিল্লাহ! বাজারে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন তাদের। সেখান থেকে একসঙ্গে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু এই ঘটনার পর শুরু হয় সমালোচনা—আন্দোলনে কেন গিয়েছিল, কেন ঝুঁকি নিয়েছিল। তবে সেই সমালোচনা বেশিদিন টেকে না।

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর, সবাই যখন মাথা উঁচু করে রাস্তায় নামে, তখন সমাজ চোখে দেখে এই তরুণরাই আসলে সত্যিকারের ‘জুলাইযোদ্ধা’। ছাত্রলীগের বর্বর হামলার মুখে পালানো, পুলিশের হয়রানি সহ্য করা, বন্ধুকে বাঁচাতে ঝুঁকি নেওয়া সবই আজ স্মৃতির পাতায় রক্তমাখা এক গর্বিত ইতিহাস।

লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, শ্রীবরদী সরকারি কলেজ, শেরপুর।