
দুর্বল প্রশাসনের সুযোগ নিয়ে গোপালগঞ্জে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণহীন। গত বুধবারের সন্ত্রাসী তাণ্ডব এর সর্বশেষ নজির। ওই দিন আওয়ামী সন্ত্রাসে গোপালগঞ্জে এনসিপির মঞ্চ ভাঙচুর ও নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় চারজন নিহত, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণসহ বিভিন্ন তাণ্ডব চলে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনীকে আগে থেকেই গোপালগঞ্জে নিয়ে রাখা হয়েছিল। এনসিপির জুলাইযোদ্ধাদের পদযাত্রা কর্মসূচির খবরে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ গোপালগঞ্জকে আরো ব্যাপকভাবে ক্যাডার ও অস্ত্রশস্ত্রের দুর্গে পরিণত করে। ঘটনার দুদিন আগে সবগুলো উপজেলা থেকে কর্মী-সমর্থকদের জড়ো করা হয়। স্থানীয় সাধারণ মানুষের সহানুভূতি নেওয়ার জন্য ‘শেখ মুজিবের কবর ভাঙা হবে’ বলে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই নীলনকশা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতি স্থানীয় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে ঘটলেও তারা তা জানতে পারেনি।
ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী সন্ত্রাসীরা থানা লুট, এসপি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া এবং জেলা কারাগার ভেঙে বন্দি আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বের করে দেওয়ার পাশাপাশি এনসিপির শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহর প্রাণনাশের টার্গেট করেছিল। তবে সন্ত্রাসীরা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করলেও পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
আইএসপিআর জানিয়েছে, সেনাবাহিনী মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও তারা (আওয়ামী সন্ত্রাসীরা) সেনাবাহিনীর ওপর অসংখ্য ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়ে হামলা করে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরে গতকালের পর্যালোচনা বৈঠকেও চিহ্নিত হয়, ওই ঘটনায় স্থানীয় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের প্রচণ্ড ব্যর্থতা রয়েছে। সভায় এটাও আলোচনা হয়, গোপালগঞ্জজুড়ে পলাতক আওয়ামী ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ঘোরাফেরা করলেও আজ পর্যন্ত তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি কায়দায় তাদের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
এনসিপি উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম গতকাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেনি। সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যে কঠোর ভূমিকায় দেখা যায়, তা আগে দেখা যায়নি।
গোপালগঞ্জ থেকে আরো অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশ রয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর গোটা দেশের আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে চলে যায়। কিন্তু ভিন্নচিত্র দেখা গেছে গোপালগঞ্জে। প্রশাসনের দুর্বলতায় গোপালগঞ্জ জেলা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এর সর্বশেষ চিত্র তরুণ জুলাইযোদ্ধাদের দলের পদযাত্রা কর্মসূচিতে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী জুলাইযোদ্ধাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ করেছে। এর আগেও গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। ওই সময় গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা স্বেচ্ছাসেবক দলের এক কর্মীকে হত্যা করে, সেনাবাহিনীর গাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং দেশের সুশৃঙ্খল বাহিনীর অস্ত্র লুট করে। ওই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম ব্যর্থতার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। গোয়েন্দা ব্যর্থতারও অভিযোগ উঠছে। এনসিপির ওপর হামলা ঠেকাতে রাজনৈতিক নেতারাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
এনসিপির ওপর আওয়ামী লীগের হামলার জেরে গত বুধবার রাত ৮টা থেকে ২২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় কারফিউ শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে ৩ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে আজ দুপুর ২টা পর্যন্ত কারফিউ বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, আজ শুক্রবার জুমার নামাজের কথা বিবেচনা করে বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে।
স্থানীয় জনগণ ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনে অগ্রভাগের সৈনিক এনসিপি নেতাদের ওপর আওয়ামী লীগের আগে থেকেই তীব্র ক্ষোভ ছিল। তারা গোপালগঞ্জ সফরে যাবেনÑএমন তথ্য পেয়ে আগেভাগেই হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বুধবার এনসিপির কর্মসূচির আগেই ঢাকা, মাদারীপুর, বাগেরহাট ও বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা গোপালগঞ্জ শহরে চলে আসে। ঘটনার দিন সকালেই জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জ শহরে এসে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি এনসিপির গোপালগঞ্জ আসার রুটগুলোয়ও অবস্থান নেয়।
৫ আগস্টের পর ‘নিরাপদ স্থান’ মনে করে অনেক চিহ্নিত আওয়ামী সন্ত্রাসী গোপালগঞ্জ গিয়ে আশ্রয় নেয়। জানা গেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গোপালগঞ্জে গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কদিন অবস্থানের পর সুযোগ বুঝে ভারতে পালিয়ে যান। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় এনসিপিসহ জুলাই আন্দোলনের অগ্রভাগের যোদ্ধাদের হুমকি দিতে দেখা গেছে। ‘সাহস থাকলে গোপালগঞ্জ আয়’Ñএমন হুমকিও নানা সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে দেখা গেছে। দেশের অন্যান্য এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকজন আত্মগোপনে থাকলেও গোপালগঞ্জে তারা এখনো প্রকাশ্যে চলাফেলা করে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের টার্গেট ছিল এনসিপির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা। বিশেষ করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারা। প্রথমে গাড়িবহরে হামলা করে ব্যর্থ হয়ে তারা পুলিশ সুপারের কার্যালয় ঘেরাও এবং আক্রমণ করে। তারা পেট্রোল দিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আগুনও দিতে চেয়েছিল। ঘটনা জানতে পেরে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নির্দেশ পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এরপর এনসিপি নেতাদের উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ থেকে খুলনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পর্যালোচনা
গোপালগঞ্জের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের পর্যালোচনা রিপোর্টের বরাতে জানা গেছে, গোপালগঞ্জকে আলাদাভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ। ঘটনার দায় উভয়ের কেউই এড়াতে পারে না। পাশাপাশি স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ না করাও একটি দুর্বলতা বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও হিন্দু অধ্যুষিত গোপালগঞ্জ অন্য ৬৩ জেলা থেকে অনেকাংশেই আলাদা। সেখানে প্রয়োজনে সমাজের আওয়ামীবিরোধী বিভিন্ন অংশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজনীয় ফোর্স আরো বেশি মোতায়েন করা জরুরি ছিল। কিন্তু জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের আলোকে যে পরিমাণ ফোর্স চাওয়া হয়েছিল, সে অনুযায়ী ফোর্স দিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। ঘটনার দিন বুধবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আইজিপি দ্রুত বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করেন। এক্ষেত্রে দায় মাঠ প্রশাসনের।
এ ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, বরিশাল থেকে নাহিদ ইসলামসহ এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জের দিকে রওনা হওয়ার খবর পেয়ে পুলিশের গাড়িতে হামলা করে ও আগুন ধরিয়ে দেয় নিষিদ্ধ লীগের ক্যাডাররা। ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে একজন ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে পাঁচজন ফোর্স পাঠানো ছিল প্রথম ভুল পদক্ষেপ। সেখানে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশ সদস্যদের ধাওয়া করলে তারা কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। এতে সন্ত্রাসীরা উৎসাহিত হয়ে আরো বেশি জঙ্গিবাদী ও মারমুখী হয়ে ওঠে। ‘পুলিশ পালিয়ে গেছে’ বলে ফেসবুকে একটি পোস্ট ছড়িয়ে দেয় আওয়ামী গুজববাজরা। ফেসবুকে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রলীগসহ অন্য ক্যাডাররা রাস্তায় চলে আসে। এর আগে ঘটনার দিন বুধবার সকালে এনসিপির সমাবেশস্থলে মাত্র ৩০ জন লীগের ক্যাডার হামলা করল, অথচ ৬০ জন পুলিশ কিছুই করতে পারল না। এ বিষয়টি প্রথমে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মধ্যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ দুটি ঘটনার ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে দেয় দেশ-বিদেশে থাকা আওয়ামী গুজববাজরা। বিদেশে পালিয়ে থাকা নেতারা এগুলো ফেসবুকে শেয়ার করতে থাকে। এ ছাড়া টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের সমাধিসৌধ ভেঙে ফেলা হবে বলেও গুজব ছড়ানো হয়।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সারজিস আলম
গতকাল একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এনসিপি নেতা সারজিস আলম ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেনি। তিনি বলেন, সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যে কঠোর ভূমিকায় দেখা গেছে, তা আগে কেন নেওয়া হলো না। সমাবেশস্থলে হামলা করার পর তাদের প্রতিহত করার পরিবর্তে পুলিশ নিজেই সেখান থেকে সরে গেছে বলে দাবি করেন সারজিস আলম। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু হলে আশপাশের জেলা থেকে ফোর্স এখানে মুভ করা শুরু হলো; তারপর তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন শুরু করে।
পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে বিবিসি
হামলার প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশের ভূমিকা দুর্বল ছিল বলে গোপালগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বাংলা বলেছে, আচমকা হামলার জন্য পুলিশ সদস্যদের প্রস্তুত দেখা যায়নি। হামলাকারীদের তুলনায় পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা কম থাকায় প্রথমে তারা পিছু হটে। পুলিশ রীতিমতো হতভম্ব এবং খুবই ভীত ছিল। ইটপাটকেল ছোড়া হলে পুলিশ ভয়ে পালাচ্ছিল।
দায়ভার সরকার ও প্রশাসনের : নাহিদ ইসলাম
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পেয়েই তারা গোপালগঞ্জে গেছেন’ উল্লেখ করে লিখেছেনÑপ্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে, সেভাবেই তারা গোপালগঞ্জে প্রবেশ করেন। তাদের ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী সেখান থেকে বের হন। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিত, তাহলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এর দায়ভার সরকার ও প্রশাসনকেই নিতে হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে আছে ফ্যাসিবাদের দোসর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, যাদের টাকা দিয়ে কিনে ফেলা যায়। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে ছিল।
তিনি বলেন, তারা বারবার আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় জুলাই গণহত্যার বিচারের কথা বললেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের লোকদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তার হলেও কোর্টে জামিন মিলছে, থানা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারের বড় ব্যর্থতা : অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, প্রশাসন কেবল গোপালগঞ্জ নয়, সার্বিকভাবেই দুর্বলতা রয়েছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে, আক্রমণ করে না। কারণ, জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের যে মনোবলটা ভেঙে গেছে, তা থেকে এই বাহিনীকে পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উচিত ছিল এই বাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিস্টের শিখণ্ডীগুলোকে বের করে দিয়ে বাহিনীটিকে সুশৃঙ্খল ও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। কিন্তু এক বছরেও সেটা তারা করতে পারেনি। এটাকে আমি সরকারের বড় ব্যর্থতাই বলব। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গরম গরম কারফিউ আশা করা যাবে না। বর্তমান সরকার সেদিকে যাবেও না।
তিনি বলেন, এনসিপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সশস্ত্র হামলা প্রমাণ করে পতিত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি। তাদের মধ্যে কোনোরকম অনুশোচনাও আসেনি। অনেকে বলছেন, এনসিপির গোপালগঞ্জে কর্মসূচি করাটা উচিত হয়নি। তবে আমি বলব, তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলায় আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হিংস্রতা দেশবাসী নতুন করে দেখল।
গোপালগঞ্জের ঘটনা অশনিসংকেত : বিভিন্ন রাজনৈতিক দল
বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গোপালগঞ্জের ঘটনাকে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে একটি অশনিসংকেত বলে উল্লেখ করেছে। দলগুলোর নেতারা বলেছেন, গোপালগঞ্জের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা এক্ষেত্রে সীমাহীন। পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যও ছিল না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি এনসিপির সমাবেশে আক্রমণের জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বলা হয়, ফ্যাসিবাদী শক্তি গণঅভ্যুত্থানের ঠিক বর্ষপূর্তির সময় যে দুঃসাহস দেখিয়েছে, তা অপ্রত্যাশিত ছিল। ফেব্রুয়ারির প্রতিশ্রুত নির্বাচন ব্যাহত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা প্রশাসনের দায়িত্ব হলেও এনসিপির কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। এটি উদ্বেগজনক। সরকারকে গোপালগঞ্জসহ বাংলাদেশের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় পরিষ্কার যে, প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ দায়িত্বে নিয়োজিতদের ব্যাপারে তদন্ত করতে হবে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন সহিংসতার সুযোগ করে দিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জনতা পার্টি বাংলাদেশের নির্বাহী চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন এবং মহাসচিব শওকত মাহমুদও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কথা বলেছেন।
হাসিনা পালানোর পর গোপালগঞ্জে যা হয়
গত বছরের ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর ‘শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’Ñএমন অভিযোগ করে ওই দিনই গোপালগঞ্জে বিক্ষোভ করা হয়। টানা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ৯ আগস্ট গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে জেলার গোপীনাথপুর মোড়ে মহড়া ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা মহাসড়ক ছেড়ে দিতে বললে তারা সেনাসদস্যদের ওপর হামলা করে। বিক্ষোভকারীদের হামলায় সেনাসদস্যরা দৌড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এতে সেনাবাহিনীর চার কর্মকর্তাসহ ৯ জন আহত হন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর দুটি রাইফেল, ছয়টি ম্যাগাজিন ছিনিয়ে নিয়ে একটি গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং দুটি গাড়িতে ভাঙচুর চালায়।
ওই ঘটনার মাসখানেক পর ১৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদারকে হত্যা করে। ওই দিন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও শেখ হাসিনার আসনের প্রার্থী এসএম জিলানী একটি সমাবেশ শেষে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার পথে মাইকিং করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার গাড়িবহরে (জিলানীর) হামলা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তাদের হামলায় দিদার নিহত হওয়া ছাড়াও জিলানীসহ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৫০ নেতাকর্মী আহত হন। ওই সময় ১০টি গাড়ি ও ৭-৮টি দোকান ভাঙচুর করা হয়।
গত ২৬ মার্চ রাতে দিদার হত্যামামলায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান মীরকে গ্রেপ্তার করলে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে তাকে চিনিয়ে নেয়। ঘটনায় মুকসুদপুর থানা পুলিশের এসআইসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হন।
কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
গোপালগঞ্জে গত বুধবার যে ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি নাÑএ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে এত পরিমাণ যে হবে, ওই তথ্য হয়তো ছিল না। তিনি বলেন, ‘যারা অন্যায় করেছে, তারা গ্রেপ্তার হবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় গোয়েন্দা তৎপরতার কোনো ব্যর্থতা ছিল কি নাÑজানতে চাইলে গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারো কোনো গাফিলতি আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হবে। পুরো ঘটনাটি তদন্ত কমিটি দেখবে।