Image description

সাভারে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী ছিলেন শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পুলিশ। গুলির পর মুমূর্ষু অবস্থায় সাঁজোয়া যানে ঘোরানো হয় তাকে। এরপর অজ্ঞাত পরিচয়ের দুষ্কৃতকারী বলে সাজানো মামলায় প্রধান আসামি করা হয়।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের এ ঘটনাটি তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঝড় তোলে। ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, মূলত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জায়েজ করতে মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে ‘দুষ্কৃতকারী’ উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে মামলা সাজায় পুলিশ। ঘটনার ১৩ দিনের মাথায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় ওই মামলাটি দায়ের করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ১৮ জুলাই সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন পাকিজা পয়েন্টে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সেই ঘটনার ভাইরাল হওয়া ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, গুলিবিদ্ধ দেহে ছটফট করা মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে নিয়েই নির্দয়ভাবে ছুটছে সাঁজোয়া যান।

যানটির পেছনে সহপাঠী আন্দোলনের যোদ্ধারা ছুটছেন, ভিডিও ধারণ করছেন। তখনো চারদিকে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। একপর্যায়ে সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে ফেলে দেওয়া হয় ইয়ামিনকে। তখনো জীবিত ছিলেন তিনি। সাঁজোয়া যানের দরজা খুলে বের হয়ে আসেন আরেক পুলিশ সদস্য। পরে আরেকজন আসে তাকে সহযোগিতা করতে। লাল গেঞ্জি পরিহিত এই সহায়তাকারী সাভার মডেল থানার রাইটার।

তারা দুজনে মিলে চ্যাংদোলা করে ইয়ামিনকে টেনেহিঁচড়ে উঁচু সড়ক বিভাজন টপকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে দেন সড়কের বিপরীত দিকের লেনে। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, তখনো নড়াচড়া করছিলেন ইয়ামিন। পুলিশের এমন নির্দয় আচরণের ভিডিও ধারণ করছিল সহপাঠী ও আন্দোলনের সহকর্মীরা। ঘটনার বেশ কিছু সময় পরে একটি রিকশা ডেকে মুমূর্ষু অবস্থায় ইয়ামিনকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় সেই ভিডিওচিত্র দেশের গণমাধ্যমে প্রচারের আগেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, যা জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পুলিশের নৃশংসতা দেখে চমকে ওঠেন সাধারণ মানুষ, ছাত্রজনতা। হতবাক হয় দেশবাসী। দেশব্যাপী রাজপথে গর্জে ওঠেন আন্দোলনকারীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভারের প্রথম শহীদ ইয়ামিন ছিলেন মিরপুরের এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থী থাকাকালে প্রত্যেক শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতেন তিনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বোন শেখ রেহানাসহ ভারতে পালানোর পর ক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দেয় সাভার মডেল থানা।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সেই সাঁজোয়া যানের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা জেলার মিলব্যারাক পুলিশ লাইন্সে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সিরাজুল ইসলাম। চালক ছিলেন কনস্টেবল আক্কাস আলী।

এ ছাড়া ছিলেন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মোহাম্মদ আলী, নায়েক সোহেল, কনস্টেবল দ্বিপরাজ ও মাসুম। রাবার বুলেট, লেড বল বুলেট ও গ্যাস শেলে সজ্জিত সেই সাঁজোয়া যানের নম্বর ছিল এপিসি-১৪। মূলত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের অত্যাধুনিক আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এপিসি। কিন্তু নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দমনে সেই এপিসিই ব্যবহার করে গুলিবর্ষণ করেছে পুলিশ। বর্তমানে এপিসিটি সাভার মডেল থানা চত্বরে রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেই ১৮ জুলাই এই এপিসির পেছনে ছিল ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মহড়া। মহড়া থেকে ছাত্র-জনতাকে গুলি করা হয় নির্বিচারে। আর সেদিন নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ডে পুলিশের নেতৃত্বে ছিলেন পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপস অ্যান্ড ট্রাফিক) আবদুল্লাহিল কাফী।

ঘটনাস্থলে আরও উপস্থিত ছিলেন সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুর ইসলাম, সাভার মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ্ জামান, আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ, সাভার মডেল থানা ও ঢাকা জেলার পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা। আবদুল্লাহিল কাফীর নির্দেশনায় দুপুর ২টা ৫ মিনিটে নবীনগর থেকে এপিসি সাভারে নিয়ে আসেন আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ। তিনি তখন বসেছিলেন চালকের পাশের আসনে।

ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে এপিসিটি পাকিজা মোড় দিয়ে ইউ-টার্ন নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আরিচাগামী এক্সপ্রেস লেন ধরে সাভার বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে একপর্যায়ে বাধার মুখে পড়ে। পুলিশ এ সময় ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ও তিনটি লং শেল এবং দুটি শর্ট শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় এমআইএসটির শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন আন্দোলনকারীদের রক্ষায় সাহস নিয়ে এগিয়ে যান সাঁজোয়া যানের দিকে।

নির্বিচারে গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ না করতে অনুরোধ করেন পুলিশ সদস্যদের। তিনি প্রতিবাদ জানাতে উঠে পড়েন সাঁজোয়া যানে। কিন্তু তার কথা শোনার পরিবর্তে ইয়ামিনকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন পুলিশ সদস্যরা। তখনও ইয়ামিন জীবিত ছিলেন। এপিসির ওপরই ছটফট করছিলেন। সেই অবস্থায় তাকে নিয়েই ছোটে সেই যানটি। এভাবে এপিসির ওপর বেশকিছু দূর ঘুরিয়ে ফেলে দেওয়া হয় সড়কে। এভাবেই মৃত্যু হয় শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের।

এদিকে ইয়ামিনের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে ঘটনার ১৮ দিনের মাথায় ৩১ জুলাই এপিসির নেতৃত্বে থাকা উপ-পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় ইয়ামিনকে ‘অজ্ঞাতনামা’ ও ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে শহীদ ইয়ামিনের বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার সন্তানকে কীভাবে পুলিশ গুলি করে মেরেছে, তা দেশবাসীর পাশাপাশি মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসী দেখেছে। হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিন পর তারা আমার ছেলেকে অজ্ঞাতনামা বলে কীভাবে? আমার ছেলের সব বৃত্তান্ত পুলিশ জানে।

পুলিশ আমাদের জানে বলেই তো আমাকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়, এমনকি সাভারের তালবাগেও পর্যন্ত দাফন করতে দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমার সন্তান শহীদ। আমি তাকে সেই মর্যাদা দিয়েই পরনে থাকা কাপড়ে দাফন করেছি। পুলিশ তো এভাবেই সাজানো মামলা দিয়ে দেশব্যাপী দানব হয়ে উঠেছিল। তারা হাসিনার রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করেছে।’

এ সময় আক্ষেপ জানিয়ে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘কষ্ট একটাই আমার একমাত্র ছেলেকে ওরা গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যার পর তাকে জঙ্গিসহ নানা উপাধি দিতে চেষ্টা করেছে। এখনো হত্যাকাণ্ডের এই নিষ্ঠুর দৃশ্য আমাদের পরিবারের কাউকে ঘুমাতে দেয় না। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ এই নির্মম পৈচাশিক হত্যার বিচার করবেন। আমি দ্রুত সময়ের মধ্যে ছেলে হত্যার বিচার দাবি করছি।’