Image description

চট্টগ্রামের মুরাদপুরে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরাম। বৈষম্যবিরোধী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ছিলেন তিনি। আজ সেই শোকাবহ ঘটনার এক বছর। পরিবারের সদস্যরা জানাচ্ছেন, ওয়াসিমের মৃত্যু এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি কেউ। তাঁর বাবা শফিউল আলম ছেলের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তখন থেকেই প্রতিদিন ছেলের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই কেটে যায় সেখানে।

ওয়াসিমের মা জ্যোৎস্না বেগম এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না যে তাঁর সন্তান আর নেই। প্রতিটি মুহূর্তে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান, চোখের সামনে ভাসে ওয়াসিমের হাসি, তার কণ্ঠস্বর, তার চলাফেরা।

কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজার পাড়া এলাকায় ওয়াসিমের বাড়ি। চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। কলেজ ও পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন ওয়াসিম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাই আরশেদ আলী বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন, সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন ছেলের মৃত্যুর পর। বড় বোন মর্জিনা আকতার ও ছোট বোন রুশনি আকতারের বিয়ে হয়েছে। সবার ছোট বোন সাবরিনা ইয়াসমিন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সহপাঠীদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, ১৬ জুলাই বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের দ্বিমুখী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ওয়াসিম। সংঘর্ষের শুরুতে লাঠিপেটা হলেও পরে পুলিশ ও সাদা পোশাকের অস্ত্রধারীরা গুলি চালায়। বিস্ফোরিত হয় ককটেলও। আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে অলিগলিতে ঢুকে হামলা চালানো হয়। পুরো এলাকা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।

ওয়াসিমের সহপাঠী ইমরান হোসেন ও তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই দৃপ্ত পদক্ষেপে সক্রিয় ছিলেন ওয়াসিম। কখনো পিছু হটেননি, বরং আরও দৃঢ়চেতা হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ওয়াসিম লিখেছিলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে আছে আমার প্রাণের সংগঠন। আমি এই পরিচয়েই শহীদ হবো।’ পোস্টটি দেওয়ার মাত্র ১৬ ঘণ্টা পর সেই ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হয়ে যায়।

ওয়াসিম কেবল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না, বরং ছিলেন বিনয়ী ও সবার প্রিয়। গ্রামের মানুষরা জানান, তিনি পড়াশোনার ফাঁকে মাঝেমধ্যে গ্রামে যেতেন এবং সবার সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশতেন। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

ওয়াসিমের পরিবার এখনো শোকসাগরে ভাসছে। মুঠোফোনে কথা হলে ওয়াসিমের চাচা মাওলানা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘ওয়াসিম কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে এভাবে হারিয়ে যাবে—এ কথা কেউ কল্পনাও করেনি। তার মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ১৬ জুলাই বিকেলের একটি গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।’

তিনি জানান, ‘আমার ইমামতিতে ১৭ জুলাই সকাল ১১টার দিকে ওয়াসিমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।’

ওয়াসিমের পরিবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, তার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। স্থানীয় বাসিন্দারাও একই দাবি জানিয়ে বলেছেন, এই পরিবারের পাশে সরকার যেন সর্বোতভাবে দাঁড়ায়।