
নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লব হয়েছিল। রাজনীতিতে সুবাতাস আসবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে এবং প্রতিহিংসা দূর হবে-এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু ক্ষমতার লোভে আবার রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের নামে ছড়ানো হচ্ছে নানা রকম কুৎসা, রটানো হচ্ছে নোংরা অপপ্রচার। এমনকি অকথ্য ভাষায় রাজনৈতিক নেতাদের গালাগালিও করা হচ্ছে। অফলাইনের চেয়ে অনলাইনে বা ডিজিটাল মিডিয়ায় এসব নোংরামি ও প্রতিহিংসা বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় যত দিন যাচ্ছে রাজনীতিতে নোংরামি ও প্রতিহিংসা তত বাড়ছে। সুস্থ রাজনীতির প্রত্যাশা দিনদিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনে বিশেষ করে বর্বরোচিত সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম নোংরামি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে টার্গেট করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যে গণতন্ত্র উত্তরণের পথে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। তাদের উচিত মতপার্থক্য দ্রত কমিয়ে আনা।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনীতি বিরোধমুক্ত না। গণতান্ত্রিক দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে। বহু দল থাকার অর্থই বহু মত-পথ থাকবে। মতের সঙ্গে পার্থক্য থাকবে। তিনি বলেন, মতপার্থক্যকে বড় করে দেখার কিছু নেই। এ মুহূর্তে যে মতপার্থক্যগুলো দেখা দিয়েছে, সেটা না দেখা দিলেই ভালো হতো। মতপার্থক্যের ফলে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে, এর আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত মতপার্থক্য যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে আনা যুক্তিযুক্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে অনৈক্যের সুর ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ভোটের হিসাবনিকাশ যত এগিয়ে আসছে বিরোধ ততই প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যারা রাজপথে শামিল ছিলেন, মাত্র ১১ মাসের মাথায় এসে তারা এখন একে অপরকে নিশানা বানাচ্ছেন। এমনকি জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত সফল গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যসহ একধরনের বিরোধ স্পষ্ট হচ্ছে। দীঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একে অপরকে কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখছে। যদিও স্বৈরাচারী হাসিনাবিরোধী ১৫ বছরের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক অবদান ও ত্যাগ রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের সময় নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ইস্যুর সমাধান না হতেই এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা চলছে।
এদিকে এমন বৈরী সম্পর্কের মধ্যে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে কেউ কেউ বিশেষ ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এমন পরিস্থিতির সুযোগ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে দলের অনেক পলাতক নেতা বিদেশে থাকাবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন। এরকম পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জটিল সমীকরণ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, নির্বাচন সংস্কার কতটুকু হবে, কবে নাগাদ হবে এবং সংস্কার শেষে নির্বাচন কবে হবে-এমন বিতর্কের পর এখন নতুন করে যুক্ত হলো অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। এটি পানি অনেক ঘোলা করতে পারে। এ ছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল, নতুন সংবিধান রচনা, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, এমনকি গণভোটের আয়োজন নিয়েও মাঠ সরগরম হতে পারে। এক কথায় বলা যায়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ছে জুলাই বিপ্লবের জাতীয় ঐক্য। তবে দেশের স্বার্থে এ মুহূর্তে সবার আগে ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্য থাকাটা জরুরি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়ায় যে ফাটল রয়েছে, সেটি দিনদিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। এতে করে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা। তাঁরা বলছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ছয় মাস কিংবা এক বছর-নির্বাচন এ দেশে হবেই। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধগুলোও তত স্পষ্ট হতে থাকবে। যার যার স্বার্থের বিষয়ে রাখঢাক না করে কে কাকে ল্যাং মেরে এগিয়ে যাবে সেই চেষ্টা চলতে থাকবে। আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ বাড়বে। বিএনপি যদি দেখে সামনের নির্বাচনে ছাত্ররা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তারা ছাত্রদেরও ছাড় দেবে না। এটাই স্বাভাবিক। এটাই রাজনীতি। অন্যদিকে ছাত্ররাও দেখছে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিএনপি। তাই তারাও বিএনপির বিষয়ে কথা বলছে। ইতোমধ্যে এসব আলামত শুরু হয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান অনৈক্যের সুর দেশের ভবিষ্যতের জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণ অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে তাই কোনো দূরত্ব বা ভুলবোঝাবুঝি কাম্য নয়। কাম্য নয়, বিরোধকে উসকে দেওয়ার মতো পরস্পরের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও। সেটি হলে দেশের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার যারা বিরোধী, তারা উৎসাহিত ও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।