
সারা দেশে প্রায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। এবার রাজধানীর বাইরে বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি সবচেয়ে বেশি। আক্রান্তদের কেউ হাসপাতালে গেলে তিনি ডেঙ্গু রোগীর তালিকায় উঠছেন। আর তাতেই হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের চেষ্টা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এসব সংস্থাগুলোর ঘুমিয়ে থাকার কারণেই ডেঙ্গুতে ভুগছেন সাধারণ জনগণ। সরকারি হিসাবে চলতি বছরে সাড়ে ১৫ হাজারের অধিক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৮ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। জুনের চেয়ে জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৪ হাজার ৩৪৫ জন। এরপর মাত্র এক মাসে অর্থাৎ জুনের ৩০ দিনে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৫১ জনে। আগের ৫ মাস মিলে যত জন ভর্তি হয়েছিল জুনে এক মাসেই তার চেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই মাসে মৃতের সংখ্যাও অনেক বেশি। আগের ৫ মাসে মারা গেছে ২৩ জন আর এই এক মাসে মারা গেছে ১৯ জন। এ ছাড়া, জুলাইয়ের ১৫ দিনে মৃতের সংখ্যা ১৬-তে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যুহার দিন দিন বাড়ছে। ডেঙ্গুর এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। তারা বলছেন, এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতার জন্য সংকেত। যা আরও গভীর চিন্তার কারণ। ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যু যেমন বাড়ছে, তেমনি এটি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। কারণ, এই সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পিক টাইম বা সর্বোচ্চ সময়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন এডিস মশার বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টি, তাপমাত্রার ওঠানামা ও আর্দ্রতার তারতম্য মশার জীবনচক্রে সহায়তা করছে এবং ভাইরাস সংক্রমণ আরও দ্রুত হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অল্প সময়ের বৃষ্টিতে যখন বিভিন্ন ছোট-বড় পাত্রে পানি জমে থাকে, তখন তা দ্রুত মশার প্রজননস্থলে রূপ নেয়। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে ২০২৫ সালের আগস্টে আমরা ২০২৩ সালের চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭৫ জন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৩ জন, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৬৭ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২৮ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ জন, খুলনা বিভাগে ২৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৫ জন, রংপুর বিভাগে ৩ জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ১৫ই জুলাই পর্যন্ত সবমিলিয়ে ১৫ হাজার ৫৮৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং নারী ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। জুন মাসে আক্রান্ত ছিল ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং মারা গেছেন ১৯ জন। অন্যদিকে জুলাইয়ে ১৫ দিনে মারা গেছেন ১৬ জন এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫ হাজার ২৮৯ জন। এটা সরকারি হিসাব। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে। কারণ অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন না, তখন তাদের পরিসংখ্যানও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিতে পারে না।
কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, গবেষণার ফোরকাস্টিং মডেল অনুযায়ী আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর এবং মাদারীপুর জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার নিতে পারে। তিনি বলেন, মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে, যা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। এই অধ্যাপক আরও জানান, তারা নিয়মিত ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করেন এবং দৈনিক ও সাপ্তাহিক ডেটার ভিত্তিতে সংক্রমণের প্রবৃদ্ধির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বগতি দেখে সহজেই অনুমান করা যায়- আগামী মাসে পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ হবে। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরের পূর্বাভাসও তাদের মডেলের সঙ্গে মিলে গেছে। ডেঙ্গু নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করা একটি টিম প্রতিদিন এই বিষয়ে গবেষণা করে। তিনি কড়া ভাষায় বলেন, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসন যথাযথভাবে কাজ করছে না। সাধারণ জনগণও ডেঙ্গুকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিচ্ছে না। এমনকি সরকারি মহলেও তাদের সতর্কবার্তাকে পাত্তা দেয়া হয়নি। সবাই ভাবছে, এসব কথা শুধু আভাস মাত্র। কিন্তু যখন বিপদ চূড়ান্ত আকার নেয়, তখন তৎপর হওয়া শুরু হয়। বরগুনায় ডেঙ্গু মারাত্মক আকার নিতে পারে, তা গত বছরই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন কেউই সেই সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দেয়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদ, আইইডিসিআর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এখন যেভাবে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, তাতে একে আর হেলাফেলা করা উচিত নয়। এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে একে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণা করা দরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে মুশতাক হোসেন বলেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দেরও সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এজন্য সরকারকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগিতা নেয়া দরকার।