Image description

উচ্চশিক্ষার কথা বলে দেশের বাইরে পাঠানোর নাম করে এক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বিএএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এম কে খায়রুল বাশার। সোমবার এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাশারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। গত ৪ঠা মে ১৪১ জন শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগে মামলা হয়। গুলশান থানায় মামলাটি করেন সিআইডি’র উপ-পরিদর্শক রুহুল আমিন। 
মামলার অভিযোগ তথ্য অনুযায়ী, খাইরুল বাশারের স্ত্রী সেলিমা রহমান ও ছেলে আরশ ইবনে বাশার মিলে এই সিন্ডিকেট তৈরি করেন। তারা চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ভিসা প্রক্রিয়া, স্কলারশিপের নামে এই অর্থ আত্মসাৎ করে সিন্ডিকেটটি। সিআইডি’র তথ্যানুযায়ী, তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ৪৪৮ জন ক্ষতির মুখে পড়েছেন। 

ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষার্থী জানান, বিদেশে যাওয়ার জন্য টিউশন ফি’র নামে ১০-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা নেয়া হয়। অনেককে আবার ভুয়া অফার লেটারও দেয়া হয়। এসব অভিযোগে বিভিন্ন থানায় ভুক্তভোগীরা প্রায় ২০০টি মামলা করেন। এসব মামলায় ১৯টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এছাড়াও আদালতে প্রায় ১০০টি ওয়ারেন্ট পেন্ডিং রয়েছে। তার বিদেশ যাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বাশার গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ভুক্তভোগী। ফেসবুকের একটি গ্রুপে তার বিরুদ্ধে নানান অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। পরিচয় গোপন করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী লেখেন, তার অন্যতম ব্যবসা ছিল বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন বাণিজ্য। এসব আবেদন করতে নেয়া হতো ১৮-২০ হাজার টাকা। তবে আবেদন না করেই আবেদন করা হয়েছে বলে জানানো হতো প্রতিষ্ঠান থেকে। পরবর্তীতে বলা হতো সুযোগ হয়নি। এছাড়াও ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভুয়া অফার লেটারের মাধ্যমেও কয়েক ধাপে লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন তারা।

কানাডা গমনেচ্ছু সামিয়া জাহান লেখেন, ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা নেয়া হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার এনে দেয়ার কথা বলা হয় প্রতিষ্ঠান থেকে। এজন্য ১৬ লাখ টাকা দাবি করে। আমার এক আত্মীয় কানাডায় থাকেন। তার মাধ্যমে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর বরাতে জানতে পারি,  ওই সেমিস্টারের শিক্ষার্থীর কোটা ফিলাপ হয়ে গেছে। আমার আবেদনও করেনি তারা। এজন্য আমি আর টাকা দেইনি। কিন্তু আবেদনের টাকা লস। সেইসঙ্গে অফার লেটারের জন্য টাকা দিলে পুরোটাই লসে পড়ে যেতাম। 
এছাড়াও খাইরুল বাশারের বিরুদ্ধে তার মালিকানাধীন ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য জিপিএ-৫ কেনারও অভিযোগ রয়েছে। 

এদিকে, গ্রেপ্তারের পর বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এম কে খাইরুল বাশারকে মঙ্গলবার আদালতে তোলা হয়। আদালত ঢাকার গুলশান থানার অর্থপাচার মামলায় তার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন, শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম ছানাউল্যাহ। আদালতে গুলশান থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই মোক্তার হোসেন জানান, আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই খালিদ সাইফুল্লাহ। শুনানি শেষে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। 

মামলার বিবরণে বলা হয়, বাশার, তার স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশার উচ্চশিক্ষার কথা বলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিতেন। ইতিমধ্যে তাদের এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থী। চক্রটি উচ্চশিক্ষার জন্য ১৪১ শিক্ষার্থীকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬৮০ টাকা লোপাট করেছে। খাইরুল বাশার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে গত ১৭ই অক্টোবর ঢাকায় বিক্ষোভ করেছিলেন একদল শিক্ষার্থী।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, উন্নত দেশে পাঠানোর কথা বলে ১০, ১২, ১৫ লাখ করে টাকা নেয়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে গেছে তাদের টিউশন ফি পরিশোধের কথা বলেও টাকা নেয়। তবে ওই টাকা তারা আত্মসাৎ করে। এভাবে বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে খাইরুল বাশারের বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক। আমার কাছে এ পর্যন্ত ১৯টি ওয়ারেন্ট আছে। 

আদালত প্রাঙ্গণে ভুক্তভোগীদের বিক্ষোভ: খায়রুল বাশারকে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করার খবর শুনে সকাল থেকেই আদালতে ভিড় করতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। সকাল ১০টার পর থেকেই দুই শতাধিক ভুক্তভোগী আদালতের সামনে এসে খায়রুল বাশারের বিচার চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর ১২টার দিকে তাকে আদালতে আনা হলে ভুক্তভোগীরা তার বিচার চেয়ে আরেক দফা স্লোগান দেন। এরপর বৃষ্টির মধ্যেই এসব মানুষ আদালত চত্বরের হাজতখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন।

বেলা তিনটার পর কড়া পুলিশ পাহারায় খায়রুল বাশারকে হাজতখানা থেকে বের করে আনে পুলিশ। এ সময় তার মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাকে এজলাসে নেয়ার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন তার উদ্দেশ্যে ডিম ছুড়তে থাকেন। 
খায়রুল বাশারকে কাঠগড়ায় তোলার পর আদালতকক্ষে থাকা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে স্লোগান দেন। বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাসে আসেন। এ সময় বাশারের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র উপপরিদর্শক খালিদ সাইফুল্লাহ সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ান। আদালতের অনুমতি নেয়ার পর তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, খায়রুল বাশারের প্রতিষ্ঠান ১৪১ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি টাকা তিনি আত্মসাত করেছেন। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা আমাদের জানিয়েছেন। আমাদের জানামতে, আরও অনেক শিক্ষার্থী বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছেন।’

সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, সমাজে যে ব্যক্তি শিক্ষায় অবদান রাখেন, তিনি একজন সম্মানিত মানুষ। বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের খায়রুল বাশার শিক্ষাকে ব্যবসায় রূপান্তর করেছেন। তিনি মানুষকে প্রতারিত করেছেন। শত শত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছেন। তিনি কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন।’

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির বক্তব্যের পর ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল সিএমএম সানাউল্লাহ বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের খায়রুল বাশারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি কীভাবে এত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করলেন?’

জবাবে খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি পরিস্থিতির শিকার।’ এ পর্যায়ে আদালত তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ খায়রুল বাশার আদালতকে জানান, তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আদালত খায়রুল বাশারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার কয় সন্তান, কয়টি বিয়ে করেছেন?’ খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি দুটি বিয়ে করেছি। আমার পাঁচটি সন্তান রয়েছে।’
আদালত বলেন, ‘আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর নাম করে শত শত শিক্ষার্থীকে বিদেশে না পাঠিয়ে তাদের টাকা আত্মসাত করেছেন। তারা তো আপনার সন্তানতুল্য। আপনি কীভাবে আপনার সন্তানতুল্য এত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করলেন? আপনি এতগুলো মানুষকে এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন!’

আদালত খায়রুল বাশারের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘আপনার নামে কতোটি মামলা রয়েছে, আপনি জানেন?’ জবাবে খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার জানামতে ৭০টি মামলা রয়েছে।’ তখন আদালত তার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে যত মামলা, যত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আপনার তো জীবন জেলেই কেটে যাবে।’ এ সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন খায়রুল বাশার।