Image description

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক অফিসের (এসইএআরও) প্রধান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বর্তমানে ছুটিতে রয়েছেন। বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের মুখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিপরীতে বিরল এক পদক্ষেপে সংস্থাটির সদর দপ্তর থেকে ক্যাথারিনা বোহমেকে সাময়িকভাবে এই অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস সম্প্রতি কর্মীদের পাঠানো এক ই-মেইলে সায়মা ওয়াজেদের ছুটির বিষয়টি আঞ্চলিক সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অবহিত করেছেন। সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা। শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের আগস্টে এক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত মার্চে সায়মার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দেশে ফিরলে তিনি গ্রেপ্তারও হতে পারেন। এক চিঠিতে তাঁকে আদালতে হাজির করতে সহযোগিতার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনুরোধও করেছে দুদক। পাশাপাশি একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রযোজ্য পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।

সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলোর একটি হলো—তিনি বেআইনিভাবে একটি সরকারি আবাসিক প্লট নিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে তাঁর পরিচালিত ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা স্থানান্তরের অভিযোগ রয়েছে। একাধিক ব্যাংককে চাপ প্রয়োগ করে এসব অর্থ ওই ফাউন্ডেশনে নেওয়া হয় বলেও উল্লেখ রয়েছে।

২০২৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক অফিসের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন সায়মা। এই নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই পক্ষপাতিত্ব ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব কুল চন্দ্র গৌতম তখন বলেছিলেন, তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর কন্যা না হতেন, তাহলে তাঁকে কেউ গুরুত্ব দিত না।

সায়মা ওয়াজেদ তখন এসব অভিযোগ ‘অপমানজনক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, তিনি এই পদে দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত।

ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই আঞ্চলিক অফিস প্রতিবছর ৫০ কোটি ডলারের বেশি বাজেট নিয়ে কাজ করে এবং ১১টি দেশের প্রায় ২০০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যনীতি ও কার্যক্রমে ভূমিকা রাখে। তবে সায়মার নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় গত মে মাসে ইন্দোনেশিয়া এই অফিস থেকে সরে গিয়ে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক অফিসে যোগ দেয়। ঘটনাটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়।

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সায়মাকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা এটিকে জবাবদিহির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হিসেবে দেখি। তবে আমরা চাই, সায়মাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ, তাঁর সব সুবিধা বাতিল এবং এই গুরুত্বপূর্ণ পদটির মর্যাদা ও জাতিসংঘ-ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হোক।’

এদিকে বাংলাদেশে সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আরও গভীর আকার নিয়েছে। ঢাকার একটি আদালত ইতিমধ্যে রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকায় তাঁর একটি অ্যাপার্টমেন্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, মামলা চলাকালে যাতে তিনি সম্পদ হস্তান্তর করতে না পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই এই পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সায়মার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তাঁকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হতে পারে। এ বিষয়ে এখনো সায়মা ওয়াজেদ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের একাধিক অনুরোধেও তিনি সাড়া দেননি।

সায়মা পেশাগতভাবে একজন মনোবিজ্ঞানী ও অটিজমবিষয়ক সচেতনতায় আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করেছেন। তবে বর্তমানে তিনি রাজনৈতিক ও আর্থিক কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধানদের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। মনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক কেন্ট বুস বলেছেন, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সততার নীতি জোরালোভাবে প্রয়োগ করলে সায়মা ওয়াজেদের প্রার্থিতা তখনই প্রশ্নের মুখে পড়ত।

কেন্টের মতে, এই ধরনের নিয়োগে আরও কঠোর যাচাই-বাছাই, প্রচারণায় ব্যবহৃত অর্থের স্বচ্ছতা এবং প্রার্থীদের নৈতিক মানদণ্ড থাকা উচিত।