
বিদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রলোভনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানার অর্থপাচারের মামলায় ‘ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজ এবং বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান লায়ন এমকে বাশারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. ছানাউল্ল্যাহ শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারক আসামির উদ্দেশে বলেন, যত মামলা হয়েছে, মোকাবিলা করতে গেলে তো সারা জীবন কারাগারে কেটে যাবে। এদিন তার দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির চার নম্বর রোডের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম টিম।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, আসামি বাশার, তার স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশার চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ১৪১ শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তারা ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬৮০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ঘটনায় গত ৪ মে সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন বাদী হয়ে মামলা করেন।
এদিন বাশারকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপপরিদর্শক খালিদ সাইফুল্লাহ তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে পুলিশ প্রহরায় তাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। এ সময় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হাতকড়া পরানো ছিল। আদালতের তৃতীয় তলায় আসলে উত্তেজিত ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কিল-ঘুষি, লাথি, পচা ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করেন। কাঠগড়ায় আসার পর তার হেলমেট খুলে দেওয়া হয়। তখন কালো মাস্ক খুলে হাসতে থাকেন। এরপর তার উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, আসামি খায়রুল বাশার রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে শিক্ষাকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করেছে। জেনেছি চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী জামাল উদ্দিন বাশারের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানিতে বলেন, বাশার ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান। লন্ডন, আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপ দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ক্যামব্রিয়ানের অনেক শিক্ষার্থীর জীবন শেষ।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী কাজী আনিসুর রহমান ও মারুফা আক্তার রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
আদালতে নিশ্চুপ বাশার
এরপর বিচারক বাশারের কাছে জানতে চান, এই কাজগুলো (শিক্ষার্থীদের কাজ থেকে টাকা আত্মসাৎ) কেন করলেন? তখন তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। ফের বিচারক বলেন, কোনো কারণে যদি তাদের বিদেশ পাঠাতে ব্যর্থ হন বা অপরাগ হন, তাহলে কেন টাকা ফেরত দেননি? তখনও তিনি কোনো কিছুর উত্তর দেননি। এরপর বিচারক বলেন, আপনার বিরুদ্ধে কতটা মামলা হয়েছে জানেন? তখন বলেন, আনুমানিক ৭০টা হয়েছে। তখন বিচারক বলেন, যত মামলা হয়েছে, মোকাবিলা করতে গেলে তো সারাজীবন কারাগারে কেটে যাবে। তখন বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, টাকাগুলো যে আত্মসাৎ করলেন আপনার মানবিক সত্ত্বা জাগ্রত হয়নি? কয়টা বিয়ে করেছেন। উত্তরে তিনি জানান, দুইটা। তখন আরেক প্রশ্ন করেন, আপনার সন্তান কয়জন? তখন তিনি বলেন, ছয়জন। বিচারক বলেন, টাকা নিয়ে এসব শিক্ষার্থীদের জীবন কেন হুমকির মুখে ফেলে দিলেন। একবারও কি আপনার সন্তানদের কথা মনে পড়েনি?
মামলার প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪৪৮ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৫৩ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। চূড়ান্ত তদন্ত শেষে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। আসামির বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একাধিক প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলা চলমান রয়েছে। আসামি একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সঙ্গে যুক্ত, যারা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। আদালতে হাজিরা শেষে গারদে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ জনতা বাশারকে আবার ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করতে থাকেন। এসময় তাদের আঘাতে পুলিশসহ সাধারণ জনতারাও আহত হন।
আদালতের সামনে মানববন্ধন, শাস্তি দাবি: বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান বাশারের বিরুদ্ধে আদালতের সামনে মানববন্ধন করে বিভিণ্ন শ্লোগান দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। পাশাপাশি তার শাস্তি দাবি করেন সংক্ষুব্ধ জনতা। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা সিএমএম আদালত ভবনের সামনে ‘ভুক্তভোগী সহস্রাধিক ছাত্রসমাজ’-এর ব্যানারে এ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
বাশারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে খবর শুনে এদিন সকাল ৯টার দিকে সিএমএম আদালত ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন তাঁরা। এ সময় বাশারের দেওয়া বিভিন্ন ভুয়া চেকের কাগজ দেখান অনেকে।
বিক্ষোভে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাখাওয়াত বলেন, ‘ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজ এবং বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান বাশার চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নানাবিধ প্রলোভন দেখাতেন। বাশার ছাত্রছাত্রীদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় পাঠানোর কথা বলে ভুয়া অফার লেটার দেখিয়ে শত শতকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী কোনো ছাত্রছাত্রীকেই বিদেশে পাঠাননি। টাকাও ফেরত দেননি।’ তাহমিনা আক্তার মুন্নী নামের আরেক অভিভাবক বলেন, বাশার ও তাঁর লোকজনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অনেক মামলা হয়েছে। আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও পাঠানো হয়েছে। অথচ টাকা ফেরত না দিয়ে বাশার তাঁর লোকজন দিয়ে ভুক্তভোগীদের ওপর হামলা করেছে এবং হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
এদিকে সিআইডির সুত্র জানায়, চটকদার বিজ্ঞাপন, ভুয়া ভিসা প্রসেসিং, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া প্রতিনিধিত্বের নাম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরাসরি অফিসে এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে টাকা আদায় করে। তদন্তে দেখা যায়, প্রতারিত অনেক শিক্ষার্থীর নামে কোনো আবেদনই বিদেশি প্রতিষ্ঠানে করা হয়নি, আবার অনেকেই বিদেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে বিপদে পড়েছেন। সুত্র আরও জানা যায়, অভিযুক্তরা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ নিজেদের নামে ও অন্যদের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে উত্তোলন করে তা দিয়ে স্থাবর সম্পদ ক্রয়, ব্যবসা পরিচালনা, এবং অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর ও রূপান্তর করেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে গুলশান (ডিএমপি) থানাসহ সারাদেশে একাধিক মামলা করা হয়েছে।