Image description

দেশে ফ্যাসিবাদী কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল জনপ্রশাসন ও পুলিশের। জনগণের সেবক না হয়ে শাসক হয়ে উঠেছিল সরকারের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সরকারি চাকরির শর্ত ভঙ্গ করে অনেক আমলা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য আবির্ভূত হয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায়। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি প্রতিষ্ঠানে আমূল সংস্কার হবে। সংস্কারের মধ্য দিয়ে লালফিতার দৌরাত্ম্য কিংবা পুলিশি রাষ্ট্র থেকে বের হয়ে আসবে বাংলাদেশ। কিন্তু অভ্যুত্থানের এক বছর হতে চললেও গণমানুষের সে প্রত্যাশা অর্জিত হয়নি।

উল্টো গত এক বছরে সচিবালয়কেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় আরো শক্তিশালী হয়েছে। বহাল রয়েছে ‘সিনিয়র সচিব’ পদমর্যাদার মতো শেখ হাসিনার দিয়ে যাওয়া উপঢৌকনও। আমলাতন্ত্রের ঘেরাটোপে আটকে পড়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগও। পুলিশের পরিস্থিতিও একই। জনগণের সেবক না হয়ে বাহিনীটির সদস্যরা এখনো রাজনীতির বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী সংস্কারে গঠিত কমিটির কোনো মৌলিক সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বরং নির্বাচন ও সংস্কারের নানা ডামাডোলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান সংস্কারের মৌলিক দাবি চাপা পড়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা বলছেন, সংস্কার কার্যক্রম যত বিলম্বিত হবে, জনপ্রশাসন ও পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানো বা জনবান্ধব হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও ততটা পিছিয়ে পড়বে।

এ মুহূর্তে জনপ্রশাসন কিংবা পুলিশের সংস্কারের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায়ই নেই বলে মনে করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রাক্তন সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকার সাধারণত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে। যেসব বিষয় সরকারের অগ্রাধিকারে রয়েছে, সেগুলোতেই নজর দেয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যে কাজ, এ মুহূর্তে সেটিই সরকারের অগ্রাধিকার। বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্কার, বিচার বিভাগের সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার—এগুলোই হয়তো সরকারের প্রায়োরিটি। এগুলো শেষ করার পরেই হয়তো সরকার জনপ্রশাসন কিংবা পুলিশ সংস্কারে নজর দেবে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে তার একটি ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’। ২০০১ সালে লতিফুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক আমলা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি এ কমিটি ১০০টিরও বেশি সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির সংস্কার প্রস্তাবগুলোর লক্ষ্য ছিল জনপ্রশাসনকে জনমুখী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। যদিও এ প্রতিবেদন জমা পড়ার পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো মৌলিক কোনো সুপারিশেরই বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে মোটাদাগে পুরনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চার প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে নতুন দুটি বিভাগ, ‘নয়াদিল্লির মতো’ কেন্দ্রশাসিত ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাসের জন্য সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। একই সঙ্গে একটির বদলে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন এবং উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে আনার প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কঠিন এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথে এগোয়নি। বরং গত ১৬ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে মহাসড়কের পেট্রল পাম্পগুলোয় স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ডায়নামিক করা, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন, কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনার মতো প্রস্তাব রয়েছে।

অবশ্য জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠিত কমিটির কার্যক্রম ও সুপারিশ নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, কিছুদিন আগে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে একটা বৈঠক হয়েছিল। তবে এর বাস্তবায়নের অগ্রগতি কতটুকু সেটা সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবেন। অনেকেরই ধারণা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব মোটেও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করেছিল বলে মনে করেন আবদুল আউয়াল মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, তারা কিছুটা তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন, সমস্যার গোড়ায় ঢুকতে চাননি। নানা দিকের টানাপড়েন এবং সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে কিছুটা বিতর্কও তৈরি হয়েছিল। এ রকম ঝগড়া অন্য কোনো কমিশনে হয়নি। আসলে ওনারা গোছাতে পারেননি। কেন পারেননি সেটা ওনারাই বলতে পারবেন। অন্য কমিশনগুলো যত স্মুদলি কাজ করেছেন বা করতে পেরেছেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সেভাবে কাজ করতে পারেনি। আরো ধৈর্য নিয়ে করলে হয়তো পারত। তবে সম্ভাবনা যে একেবারে শেষ সেটাও নয়। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জুলাই সনদ ও নির্বাচন। এ দুটা ঠিকমতো হলে সরকার ধীরে ধীরে জনপ্রশাসনে হাত দিতে পারবে।’

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বণিক বার্তকে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল প্রতিবেদন তৈরি ও তা জমা দেয়া। আমারা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। বাকিটা সরকারের বিষয়।’

শেখ হাসিনা সরকারের ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা বিরোধী মতের মানুষকে দমন-পীড়নে বড় ভূমিকায় ছিল পুলিশ বাহিনী। গত বছরের গণ-আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশেই পুলিশ সদস্যরা এবং তাদের স্থাপনাগুলো ব্যাপক মাত্রায় জনরোষের শিকার হয়। সে সময় দায়িত্বরত অবস্থায় প্রাণ হারান ৪৪ পুলিশ সদস্য। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পুলিশকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে নয় সদস্যের পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে গত ১৫ জানুয়ারি সংস্কার প্রস্তাব, সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সুপারিশে পুলিশের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়াতে জোর দিয়ে পৃথক পুলিশ কমিশন গঠনসহ বলপ্রয়োগ, আটক, গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদে আমূল পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন এবং র‍্যাবের প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে। সে সময় ৩৫২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ১৪টি সুপারিশ করে কমিশন। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশ ও জনগণের সম্পর্কে সৃষ্ট গভীর ক্ষত নিরাময়ের লক্ষ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি এসব সুপারিশ তুলে ধরে। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে এ কমিশন নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। তবে বিবেচ্য কমিশনের গঠন-কাঠামো, কার্যাবলি ও পরিধি কেমন হবে, তা আরো বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা সমীচীন হবে।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জমা দেয়ার প্রায় ছয় মাসে পুলিশে কতটা সংস্কার হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি গত ১৫ জানুয়ারি পুলিশ সংস্কারের প্রস্তাবসহ প্রতিবেদনটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছি। এটুকুই আমার দায়িত্ব ছিল। পরবর্তী বিষয়টি ওনারা বিবেচনা করবেন। এর বাইরে আমার বলার কিছু নেই।’

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্যরা মনে করেন, সংস্কারের মাধ্যমে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার পথ সুগম হবে। পাশাপাশি জনপ্রশাসন ও পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতেও সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এ সংস্কার কার্যক্রমে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। পুলিশ সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমর্থন অপরিহার্য। পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেও সংস্কার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এসবের চেয়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এ সংস্কার কার্যক্রমের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও অঙ্গীকারের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে। মানবাধিকার সুরক্ষা, বলপ্রয়োগ নীতি, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, বিদ্যমান আইনি কাঠামোর সংস্কার, অযাচিত হয়রানির (আটক বা গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদকেন্দ্রিক) অবসান, বিদ্যমান বিভিন্ন সেবার মানোন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, পুলিশের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন, জনসম্পৃক্ত পুলিশিংয়ের প্রসারসহ ১৫টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারের আমরা যে প্রস্তাব তৈরি করেছি সেটা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেয়া হয়েছে। উনি এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন। সেক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবের অনেক কিছুর সঙ্গে তারা একমত নাও হতে পারেন। বিশেষ করে পুলিশকে ভিন্নমত দমনে পুনরায় রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকলে এ প্রস্তাবগুলোর অনেক কিছু তারা বাদ দিতে পারেন। এমন কিছু করা হলে পুনরায় পুলিশের ওপর থেকে জনগণের আস্থা হারিয়ে যাবে। আপনারা দেখেছেন ইতিমধ্যে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। এখন যদি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে এ অধ্যাদেশ বাতিল করে পুনরায় পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র তুলে দেয়, সেক্ষেত্রে পুলিশ আগের চেহারায় ফিরে যেত পারে। অতএব জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সংস্কারের বিকল্প নেই।’

এদিকে বাহিনীতে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জানান, বিগত সময়ে পুলিশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘাটতি ছিল জবাবদিহির। আর এ কারণেই হেফাজতে নির্যাতন, হত্যা ও গুমের মতো অপরাধগুলোর সঙ্গে বাহিনীর সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের প্রাণঘাতী অস্ত্রগুলোও বেপরোয়া করে তুলেছিল পুলিশকে। তারা ভিন্নমত দমনে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নজিরও স্থাপন করেছিল। এছাড়া স্বচ্ছতার ঘাটতিও পুলিশ সদস্যদের নির্বাচন কারচুপির মতো অপরাধে সম্পৃক্ত করে তুলেছিল। সব মিলিয়ে পুলিশের সার্বিক কার্যক্রম তাদের এক প্রকার জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছিল। আর সেখান থেকেই পুলিশের ওপর সাধারণ জনগণের তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়, যার বহিঃপ্রকাশ গত ৫ আগস্টের আগে ও পরে প্রকাশ্যে আসে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছে। ফলে পুলিশ জনগণের বন্ধু না হয়ে চরম শত্রুতে পরিণত হয়। সেই জায়গা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি পুলিশ। সংস্কার কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

মানবাধিকার কর্মী ও গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে প্রস্তাবগুলো পুলিশ সংস্কার কমিশন থেকে এসেছে সেগুলো কার্যকর করা খুবই দরকার ছিল। এ সংস্কার প্রস্তাব কার্যকর যত বিলম্বিত হবে, পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানোও ততটাই বিলম্বিত হবে। এতে জনবান্ধব পুলিশিং বা কাঙ্ক্ষিত পুলিশি সেবা প্রাপ্তি থেকে জনগণ বঞ্চিত হবে। আশা করি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো কার্যকরে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।’

অবশ্য পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার অনেকগুলো বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। যেমন পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগ করার, যেটা আগে তিন ধাপে করা হতো। আমরা ইতিমধ্যেই এটা পাঁচ ধাপে করতে শুরু করেছি। এর ফলে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দাবিদাওয়ায় আন্দোলন কর্মসূচি চললেও সেখানে কোনো বড় হতাহতের ঘটনা ঘটছে না। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ছিল, প্রতিটি থানায় একজন নারী ডিউটি অফিসার দেয়া, সেটাও করা হয়েছে। তবে কাচ ঘেরা কক্ষে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যে সুপারিশ তারা করেছে, সেটা চাইলেই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব না। এটার জন্য থানার অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। থানায় কাচ ঘেরা কক্ষ নির্মাণ করতে হবে। এ বিষয়েও ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যে একেবারে চাপা পড়ে গেছে আমি সেটি বলব না। তবে সংস্কার কমিশন প্রস্তাবের পাশাপাশি কিছু সুপারিশও দিয়েছে। এর মধ্যে স্বাধীন কমিশন গঠনের একটি সুপারিশ আছে। এটাই আসল বিষয়। পুলিশকে পরিবর্তন করতে হলে সবার আগে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে। কিন্তু এ সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা লক্ষ করছি না। এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করলে আগামীতেও আমরা প্রত্যাশিত জনবান্ধব পুলিশিং করতে পারব না।’