Image description

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর আলোচনায় বাণিজ্যের বাইরেও অন্যান্য বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যের বাইরের বিভিন্ন শর্ত নিয়েই মূল দরকষাকষি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফার বৈঠকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে ওই বৈঠক হয়।

এদিকে, ওয়াশিংটন থেকে ফিরে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গতকাল সোমবার ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি বাণিজ্যের বাইরে বিভিন্ন শর্তের বিষয়টি উল্লেখ করলেও বাণিজ্য উপদেষ্টা বিস্তারিত কিছু বলেননি। কেননা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্ভাব্য শুল্ক চুক্তির বিষয়ে আগে থেকে প্রকাশ না করার বিষয়ে সরকারের চুক্তি রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা অনেক প্রশ্নের জবাব দেননি। না দেওয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (গোপনীয়তার চুক্তি) রয়েছে। এর ফলে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।

এদিকে গতকালের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনা হবে। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সময় পাওয়া যাবে। আশা করা যাচ্ছে, বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে। আগামী ১ আগস্টের আগেই যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক নির্ধারণে সক্ষম হবে। প্রসঙ্গত, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে জানিয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আলোচনার দরজা খোলা রাখার কথাও জানিয়েছে দেশটি।

সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য বড় ধরনের অভিঘাত বলে আমরা গুরুত্ব দিয়েই কাজ করছি। কিছু কাজ করা হয়েছে, আরও কিছু করতে হবে। তার অংশ হিসেবে আমরা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তাদের মতামত নিলাম।’

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার অগ্রগতি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যা অবহিত করা হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট।

বাণিজ্যের বাইরের ইস্যু
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাচ্ছে, যার মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুও থাকবে। এর মানে দাঁড়ায়, তারা শুধু বাণিজ্য নয়, বৃহত্তর কৌশলগত ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়। এর মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে অতিরিক্ত না ঝুঁকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুধু বাণিজ্য নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়; বিস্তৃত কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়ও রয়েছে। 

সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ যেন তার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) পক্ষে থাকে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিস্তৃত কৌশল, যার লক্ষ্য হচ্ছে পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা। শুল্ক আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে চীনের বাড়তে থাকা ব্যবসা-বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। দেশটি চায়, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উৎসাহিত না করুক।

সূত্র আরও জানায়, আরও কিছু স্পর্শকাতর শর্তে বাংলাদেশ দরকষাকষি করছে। এমন শর্ত রয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। তা ছাড়া যেসব মার্কিন পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলো অন্য কোনো দেশকে না দেওয়ার শর্ত রয়েছে।

জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গত রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, দ্বিতীয় দফা আলোচনায় একটি প্রাথমিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে তারা নিরাপত্তা উদ্বেগসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। 

তিনি আরও বলেন, আমেরিকার কিছু কৌশলগত বিষয়ে রয়েছে। তার মধ্যে নিরাপত্তা ও অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পবন্দর ও রাজস্ব অধিকতর গতিশীল করার জন্য সরকার গঠিত কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এ কথা বলেন। তিনি ওই কমিটির প্রধান।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক
বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনওয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ, র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আবদুর রাজ্জাক, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান, এফবিসিসিআইর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, শুল্ক আলোচনায় বাণিজ্যের বাইরেও অন্যান্য বিষয় রয়েছে। তবে গোপনীয়তার চুক্তি উল্লেখ করে বৈঠকেও তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যের বিষয়টি গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকেও উঠে আসে। এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি বাণিজ্য উপদেষ্টা। তবে বৈঠকে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়, এসব ক্ষেত্রে যেন দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। 

সূত্র জানায়, বৈঠকে দরকষাকষির ক্ষেত্রে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব আসে। তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, গোপনীয়তার চুক্তি থাকার কারণে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সহযোগিতা নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, সরকার ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। তবে দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নিজ উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলে করতে পারে। 

বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক যেন প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়ার চেয়ে বেশি না হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শুল্ক কিছুটা হলেও কমবে এমন আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়।

পাঁচ বছর মেয়াদি রোডম্যাপ করার পরামর্শ 
বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা দেওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন কোন পণ্যের আমদানি আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ প্রসঙ্গে গত বাজেটে তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ যে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়, তা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, সরকার এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। যে কোনোদিন এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলায় উৎপাদিত তৈরি পোশাকে সে দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে উত্থাপনের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ দীর্ঘ দিন ধরে এ বিষয়ে লবিং করে আসছে। 

বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের নিট ক্যাটেগরির সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, দু’দেশের মধ্যে আলোচনার বিষয় এবং অগ্রগতি প্রকাশ না করার শর্ত থাকায় অনেক কিছুই বাণিজ্য উপদেষ্টা বলতে পারেননি। তবে যতটুকু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের আলোচনা ইতিবাচক মনে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আশা করি, শুল্কভার কিছুটা কমবে। পণ্যের উৎসবিধির শর্তও শিথিল হবে। তবে কোনে কিছুই এখনও চূড়ান্ত নয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের তুলায় উৎপাদিত পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব প্রসঙ্গে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমেরিকান কটন গ্রোয়ার অ্যাসোসিয়েশন (এসিজিএ) এ বিষয়ে সে দেশের সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ এখানে জোর দিলে মার্কিন সরকার রাজি হতে পারে।

শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় তালিকা
প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে পণ্যের বড় তালিকা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে অনেক মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছে। যেমন তুলা, গম, সয়াবিন বীজ ও তেল এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানিতে শুল্ক নেই। তালিকার কোন কোন পণ্যে নতুন করে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া যায়, তা নিয়ে এনবিআর অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করবে। এর বাইরেও অশুল্ক বাধা, মেধাস্বত্ব, সরকারি কেনাকাটা, ভর্তুকি, শ্রম অধিকারসহ বেশ কিছু ইস্যু সমাধানে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফার শুল্ক আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিনের বৈঠক শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসিতে শেষ হয়। বৈঠকের পর শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এবং ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে আরও কিছু বিষয়ে দুই দেশ একমত হলেও কয়েকটি বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। 

গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এ শুল্ক আরোপ করার পর বিশ্ববাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে ৭ এপ্রিল এ শুল্ক ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। গত ৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো এক চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানান। নতুন এ শুল্কহার ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।