
বগুড়ায় চাকরি করতে আসা পুলিশ বাহিনীর অনেকেই এখানে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। ১৭ বছর ধরে এখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন দাপটের সঙ্গে। জানা গেছে, এসব সম্পদ গড়েছেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই। এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে বগুড়ায়। তাদের কারো কারো গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ ও জয়পুরহাটে।
তারা সবাই পুলিশ বাহিনীর সদস্য। কেউ বর্তমানে কর্মরত, কেউ এখন অবসরে। বগুড়ায় থাকার সময়ই এসব বাড়ি বা জমি কিনেছেন। এসব সম্পদ তারা নিজের নামে না কিনে স্ত্রী, সন্তান বা স্বজনদের নাম ব্যবহার করেছেন। বগুড়া পুলিশ লাইনসের পাশে লতিফপুর, চকলোকমান, গন্ডগ্রাম, ফুলদিঘিতে অনেকের জমি ও বাড়ি রয়েছে। শহরের অভিজাত এলাকা জলেশ্বরীতলা, মফিজ পাগলার মোড়, রহমাননগর ও মালতিনগরে রয়েছে বেশকিছু ফ্ল্যাট ও বাড়ি।
পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, বাহিনীপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য নিজ জেলার বাইরে অন্য কোথাও সম্পদের মালিক হতে পারেন না। কিন্তু বগুড়ায় যারা সম্পদ করেছেন, তারা কেউই কোনো অনুমতি নেননি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো পুলিশ সদস্য একবার এখানে বদলি হয়ে এলে আর যেতে চান না। বদলি ঠেকিয়ে ঘুরেফিরে একই জেলার এই থানা থেকে সেই থানায় চাকরি করেন। এভাবে দীর্ঘদিন একই থানায় থাকার কারণে মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ ও অপরাধীদের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে।
এতে করে অনেকে ‘উপরি আয়ে’ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। সেই অর্থ দিয়েই গোপনে জায়গাজমি বা সম্পত্তি কেনেন। যদিও ৫ আগস্টের পর কিছু সদস্য বদলি হয়েছেন, তারপরও অধিকাংশ লোক এখনো বগুড়ায় কোনো না কোনো থানায় চাকরি করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া পুলিশ লাইনসের পেছনে লতিফপুর কলোনির বালুবিশা পুকুরপাড়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে ‘ক্ষণিকের আশ্রয়’ নামে একটি পাঁচতলা বাড়ি। মালিকের খোঁজ করতেই একজন বললেন, এটা পুলিশের বাড়ি। পাশের বাড়িটি অবসরে যাওয়া এসআই আব্দুর রহমানের।
লতিফপুর বিহারি কলোনি এলাকায় একজন চাকরিরত সার্জেন্টের বাড়ি রয়েছে। বগুড়া পুলিশ অফিসে ডিএসবিতে চাকরি করা একজনের রহমাননগরে বহুতল ভবনের সদ্য নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকায় চাকরি করা অ্যাডিশনাল ডিআইজি শফিকুল ইসলাম ৪ মাস আগে লতিফপুরে ২৫ শতক জমির ওপরে বাউন্ডারিসহ দোকান নির্মাণ করেছেন।
লতিফপুর, চকলোকমান, কলোনি এলাকায় পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকার শতাধিক পুলিশ পরিবার তাদের নিজস্ব জমি ও বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে। তারা সবাই বিগত দিনে কম-বেশি বগুড়ায় ছিলেন এবং আছেন।
লতিফপুরে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলামের বাড়িতে তার পরিবার থাকে। তার এক ছেলেও পুলিশের কনস্টেবল। গ্রামের বাড়ি নওগাঁ হলেও বগুড়ায় কর্মরত থাকার সময় সাইফুল এই বাড়ি করেন।
সদর ও শাজাহানপুর থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) আতিয়ার রহমানের বাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে। বগুড়ায় থাকার সময় শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় বেশকিছু জায়গা কিনে বাড়ি করেন।
গাবতলী মডেল থানা ও শিবগঞ্জ থানার সাবেক ওসি আবদুর রশিদ সরকারের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। তিনি বাড়ি করেন শহরের নুরানী মোড় এলাকায়; এটি তার স্ত্রীর নামে করা।
বগুড়া সদর ও নন্দীগ্রাম থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলেন হাসান শামিম ইকবাল। বর্তমানে তিনি অবসরে। শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। শহরের জহুরুলনগর এলাকায় ‘শাহাব ভিলা’ নামে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন বগুড়া সদর থানা ও মোকামতলা তদন্তকেন্দ্রে এক সময় চাকরি করা সাবেক এসআই আবদুর রাজ্জাক।
গাবতলী মডেল থানার ওসি খায়রুল বাশার আগে বগুড়া সদর থানায় টহল উপপরিদর্শক (সদর ফাঁড়ি পুলিশ) ছিলেন। ওই সময় তিনি গণ্ডগ্রামে একটি বাড়ি করেন। শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠ-সংলগ্ন জলেশ্বরীতলায় একটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন তিনি।
একসময় বগুড়ায় চাকরি করা সিআইডির পরিদর্শক আবদুল মান্নানের বাড়ি ভোলা জেলায়। বগুড়ায় ডিবি ও শাজাহানপুর থানায় ওসি হিসেবে ছিলেন দীর্ঘদিন। পৌরসভা-সংলগ্ন জেলখানা সড়কে গাজী টাওয়ারের ছয়তলায় একটি ফ্ল্যাট এবং শহরের মালতিনগর এলাকায় ৫ শতাংশ জমি আছে তার।
বগুড়ায় একসময় চাকরি করা সাবেক এসআই সানোয়ার হোসেন। শহরের লতিফপুর এলাকায় দুটি বাড়ি ও ফুলতলা এলাকায় কিছু জমি কেনেন তিনি।
এছাড়া অতিরিক্ত ডিআইজি হামিদুল আলম মিলন তার স্ত্রীর বদৌলতে বগুড়ায় দিব্যি ফ্ল্যাটের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অবসরে যাওয়া ও চাকরিতে থাকা শতাধিক পুলিশ সদস্যের বাড়ি রয়েছে লতিফপুরে, যা পুলিশ মহল্লা (কলোনি) বলে পরিচিতি পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রবেশদ্বার বগুড়া। কাজেই, এখানে এসে সবাই স্থায়ী নিবাস গড়তে আগ্রহী। এসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে অনেকেই মুখ না খুললেও যারা ওইসব বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন বা প্রতিবেশী রয়েছেন, তারা ভাড়া নেওয়া বাড়িগুলো পুলিশের বাড়ি বলে জানিয়েছেন।
বগুড়ায় পুলিশের বাড়িঘর নিয়ে সুশাসনের জন্য প্রচার অভিযানের (সুপ্র) সাধারণ সম্পাদক কে জী এম ফারুক ও সুজনের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবীর তুহিন বলেন, আইন আছে, প্রয়োগ হচ্ছে না। এ কারণে কেউ আর আইনের তোয়াক্কাও করছেন না। সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে পুলিশি আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন তারা। এসব বিষয়ে অবশ্যই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
জেলা পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, পুলিশের বিধানে আছে বাড়ি ভাড়া নিলেও তাদের পারমিশন নিতে হয়। সেখানে পারমিশন না নিয়ে কেউ যদি বহুতল ভবন কিংবা স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলেন, তার বিরুদ্ধে তথ্য নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।