Image description

দেশে অপরাধীদের বেপরোয়া এবং নৃশংস আচরণের পেছনে রাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে একটি অপরাধপ্রবণ সমাজের শিকড় আরো গভীরে যাবে বলে মনে করছেন তারা৷

পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে যখন ব্যবসায়ী লাল চাঁন সোহাগকে  দিনের বেলা প্রকাশ্যে পাথর আর ইট দিয়ে হত্যা করা হয় তখন সেখানে অনেক মানুষ ছিলেন৷  আশপাশের দোকানে ব্যবসায়ীরা ছিলেন৷ কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার বা রক্ষায় এগিয়ে যায়নি৷ সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ ওই ঘটনার ভিডিও করেছেন৷ দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর মিটফোর্ড হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসাররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে৷ যে আসামিরা ধরা পড়েছে তাদের একজনের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷ তাকে প্রশ্ন করা হয় এমন নৃশংসভাবে মানুষ কি মানুষকে হত্যা করে? সেখানে তার জবাব ছিল: ‘‘এরচেয়েও নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ এটা তেমন কিছু না৷”

সোহাগ হত্যাকাণ্ড বুধবার ৯ জুলাই ঘটলেও ১১ জুলাইয়ের আগে তেমন কোনো সংবাদ মাধ্যম বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেনি৷ পাথর ও ইট দিয়ে থেঁতলে হত্যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর সংবাদ মাধ্যম সরব হয়, সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়৷

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে নিজেদের হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই নৃশংসতার পথ বেছে নেয় অপরাধীরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা এই ধরনের একটি প্রবণতা দেখছি৷ কারণ অনেক মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা মব করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা প্রশংসিত হচ্ছে৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়েছে৷ এখানে কোনো না কোনোভাবে নৃশংসতারও প্রশংসা হয়েছে৷ একই সঙ্গে রাজনৈতিক বা অন্যকোনো কারণে যদি রেহাই পাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে তারা আরো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত হয়৷ ফলে তারা আরো বড় অপরাধী হয়ে ওঠে৷''

এতগুলো মানুষের উপস্থিতিতে এ ঘটনাটি ঘটল, কেউ এগিয়ে গেলো না কেনো? এর উত্তরে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘ব্যক্তি যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করে না তখন সে অন্যের বিপদে সরাসরি এগিয়ে যায় না৷ এখানে ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ অপরাধের প্রতিবাদ করলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়৷ তাই সবাই নিজে নিরাপদ থাকতে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করে৷ কারণ সেখানে যে কিছুটা নিরাপদ মনে করে৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘‘কিছু মানুষ আছে যারা অপরাধ প্রবণ৷ তাদের বলা হয় লাইকলি অফেন্ডার৷ তারা অপরাধের সুযোগ খোঁজে৷ তারা সুইটেবল টার্গেট খোঁজে৷ তারা কখন অপরাধ করলে সেটা এফেকটিভ হবে তা বিবেচনা করে৷ তারা দেখছে অপরাধ করলে তারা পার পাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ আর তৃতীয়ত হলো লিগ্যাল গার্ডিয়ানশিপ৷ মনিটরিং, সার্ভিলেন্স, বিচার এগুলো ঠিক মতো হচ্ছে না৷ অপরাধের ক্ষেত্রে টেকনিক অব নিউট্রালাইজেশন আছে৷ এর পাঁচটি ভাগ আছে৷ ওই পাঁচটি বিষয় দূর করা না গেলে রাষ্ট্র ও সমাজে অপরাধ বাড়ে৷ প্রথম হচ্ছে দায় না নেওয়ার সংস্কৃতি৷ সর্বশেষ যে সোহাগ মার্ডার কেউ এর দায় নিতে চাচ্ছে না৷ দ্বিতীয়ত, কেউ স্বীকার করতে চায় না যে তার কারণে এটা হয়েছে৷ কেউ দায় দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে৷ আবার কেউ দায় দিচ্ছে রাজনৈতিক দলকে৷ তারা আবার অস্বীকার করছে৷ তৃতীয়ত, ডিনায়েল দ্য ইনজ্যুরি৷ বলা হচ্ছে তার নিজের কারণেই সে হত্যার শিকার হয়েছে৷ সে নিজেও চাঁদাবাজ৷ চতুর্থত, কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নিয়েও প্রশ্ন করা হয়৷ একটি রাজনৈতিক দল কথা বললে আরেকটি রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়৷ বলা হয় আপনি কথা বলার কে? সর্বশেষ, অ্যাপিল টু দ্য হায়ার লয়ালটি৷ তারা ওই নেতৃত্বকে খুশি করতে যেকোনো কাজ করে৷ আর নেতৃত্বও তাকে শেল্টার দেয়৷ এই পাঁচটিই আমাদের এখানে বিদ্যমান৷”

অপরাধীদের নৃশংসতা আর সাধারণ মানুষের নিষ্ক্রিয়তাই নয়, মানুষ দলবদ্ধ সহিসংতায়ও জড়িয়ে পড়ছে৷ আর এই ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরাও৷

পুরোনো ঢাকার ঘটনার পর ১১ জুলাই খুলনায় বহিষ্কৃত যুবদলনেতা মোল্লা মাহবুবুর রহমানকে হত্যা করা হয় নগরীর দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় তার নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে৷ কিন্তু এখানেই শেষ নয়৷ তাকে গুলি করার পর তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে কুপিয়ে তার পায়ের রগ কাটা হয় হয় প্রকাশ্যে৷ কিন্তু এখনো পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি৷ কুমিল্লায় তিন জুলাই সকালে মা, মেয়ে ও ছেলেকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ মোবাইল ফোন চুরির অপবাদ দিয়ে মব তৈরি করে তাদের হত্যা করা হয়৷ ৯ জুলাই চট্টগ্রামে স্ত্রী ফাতেমাকে ১১ টুকরা করে হত্যা করে তার স্বামী সুমন৷ ঢাকার ধামরাইয়ে সৈয়দা শিরিন আক্তার নামে এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা ৫ এপ্রিল প্রকাশ্যে৷

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে সারা দেশে মব ভায়োলেন্স বা গণপিটুনির শিকার হয়ে ৮৯ জন নিহত হয়েছেন৷ তার মধ্যে ঢাকা বিভাগেই নিহত হয়েছেন ৪৫ জন৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন, ‘‘গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্র ও সমাজ যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং আইনের শাসনের পথে হাঁটতে চায় সেই ব্যবস্থাগুলো আমরা দেখছি না৷ ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে৷ বিচার নিশ্চিত না করা গেলে এরকম হবে৷ এর সঙ্গে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, আছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়৷ সবমিলিয়ে পরিস্থিতি এমন হচ্ছে৷ আর এখানে এখন প্রতিবাদ করলে মানুষ নিগ্রহের শিকার হয়, তার নিরপত্তা নাই৷ এই কারণে কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় মামলার সাক্ষীও হতে চায় না৷ একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে৷ তারা আরো নৃশংস হচ্ছে৷”

তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘‘এর ফলে সমাজে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে৷ মানুষ মনে করছে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে, প্রতিবাদ না করলে, অন্যের বিপদ দেখলে নিজে ঘরে ঢুকে গেলে সে নিরাপদ থাকবে৷ কিন্তু বাস্তবে সে এতে আরো অনিরাপদ হয়ে পড়বে৷

সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘‘সাধারণভাবে বলা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা এবং অপরাধীরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে আশ্রয় পাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷”

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একথা অনস্বীকার্য যে, ৫ আগস্টের পরে আমরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি৷ আমাদের প্রচেষ্টা ছিল জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে দ্রুততম সময়ে সাহস ও মনোবল অটুট রেখে পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করা৷ প্রাথমিক ধাক্কা বা সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠে পুলিশ এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী৷ পুলিশ সারাদেশেই অপরাধ প্রতিরোধে তৎপর আছে৷ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে কার্যক্রম আরো জোরদার করেছে৷”

অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সোমবার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘চলতি বছর দেশে অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবর সঠিক নয়৷ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে করে দেখা গেছে চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি৷”

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে বড় ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল রয়েছে৷ বেশিরভাগ গুরুতর অপরাধের হার কমছে বা একই পর্যায়ে রয়েছে৷ তবে কিছু নির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে সামান্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে৷”