Image description

হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে ২০০৯ সালে সংসদ সদস্য হয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তা সত্ত্বেও প্রকাশিত গেজেট বাতিল করে তাকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশনের দাবি, আইনে বাতিলের ক্ষমতা সাংবিধানিক সংস্থার হাতে না থাকায় তাদের অপারগতার কথা জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দুদককে এখন ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সংস্থার নিজস্ব আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে। ফলে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী প্রমাণের কাজটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

এদিকে ভবিষ্যতে হলফনামায় হাসিনার মতো মিথ্যা তথ্য দিয়ে যদি কোনো প্রার্থী জয়ী হন, পরে যাতে পার না পান, সে লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে নতুন বিধান যুক্ত করার চিন্তাও করছে না কমিশন। ফলে অসাধু ব্যক্তিরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে একবার বের হতে পারলে ইসির অক্ষমতার কারণে শাস্তির মুখোমুখি হওয়া লাগবে না। কারণ একবার গেজেট জারি হলে আইনে সেটি বাতিলের ক্ষমতা নেই ইসির।

 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে মিথ্যা হলফনামা দিয়ে সংসদ সদস্য হন। দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তিনি সম্পদের তথ্য গোপন করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-১৯৭২ অনুযায়ী, নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে তিনি অযোগ্য ছিলেন। তার সংসদ সদস্যপদ ছিল অবৈধ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নিয়োগ ছিল অবৈধ এবং একই কারণে ২০০৯ সালে তার নেতৃত্বে গঠিত সরকারটিও ছিল অবৈধ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ব্যাপক তদন্তে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উদঘাটিত হয়েছে।

তদন্তে উঠে এসেছে শেখ হাসিনা স্থাবর সম্পদ হিসেবে ২১ দশমিক ৯১ একর জমির তথ্য গোপন করেছেন। প্রায় দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদও লুকিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি আমদানি করা এক কোটি ৯৩ লাখ টাকা দামের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির তথ্যও গোপন করেছেন। বেনামে গাড়িটি কিনে জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তিনি আইন লঙ্ঘন করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মাসুদুর রহমান বিষয়টি তদন্ত করেছেন। তদন্ত শেষে সুপারিশে দুদক আইনের দুটি ধারায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে বলা হয়। ২০০৮-পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা আর কোনো অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন কি নাÑতা নতুন করে তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়। বেনামে শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার কেলেঙ্কারির জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এ ছাড়া ২০০৮ সালের নির্বাচনি হলফনামায় তথ্য গোপন করার বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশন তা পর্যালোচনা করে পাঠিয়েছেন। মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা তাদের পর্যবেক্ষণগুলো দেখব। এরপর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করব।’

ইসি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্পদের বিবরণীতে কমবেশি দেখানোতে প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতায় খুব বেশি ম্যাটার করে না। কারণ সম্পদ বিবরণী নির্ণয় করার পরিমাপক হিসেবে অযোগ্যতা আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অনুসন্ধান প্রয়োজন হয়। এরপরও সম্পদের তথ্য গোপনের কারণে ফৌজদারি মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু হলফনামায় যিনি কিংবা যার মাধ্যমে অঙ্গীকারনামা বা নোটারি করেছিলেন, সে কর্তৃপক্ষটি ছিল ভিন্ন। তাই এক্ষেত্রে চাইলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা নোটারি কর্তৃপক্ষ ক্ষেত্রমতে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মামলা করতে পারে।

ইসি সূত্রের দাবি, যদি রিটার্নিং অফিসার হলফনামার অঙ্গীকারনামায় সত্যায়ন করতেন, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে কমিশন মামলা দায়ের করতে পারতেন। সে পথ খোলা না থাকায় আইনি বাধায় অবৈধ প্রধানমন্ত্রী জেনেও গেজেটটি বাতিল করতে পারেনি এএমএম নাসির উদ্দিনের কমিশন।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ আমার দেশকে বলেন, ‘তথ্য গোপনের বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করেছি। সেখানে শেখ হাসিনার সম্পদের বিবরণী গোপন করার বিষয়টি সরাসরি অযোগ্যতার মধ্যে পড়ে না।’ তিনি বলেন, ‘ধরেন, তিনি ঋণখেলাপি ছিলেন কিংবা ভুল তথ্য দিয়েছেন, কিন্তু অযোগ্য হিসেবে আরপিও ও সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। কারণ সম্পদ থাকলেও তিনি পাস করবেন, না থাকলেও করবেন। এটা অযোগ্যতার মধ্যে ঠিক পড়ে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু তিনি ভুল তথ্য দিয়েছেন, ক্রিমিনাল অপরাধ হিসেবে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। কিন্তু সেটিও আমরা করতে পারব না। কারণ হলফনামার পারপাসে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ না। চাইলে যার কাছে অঙ্গীকারনামা করেছিলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা যিনি নোটারি করেছিলেন তিনি অথবা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মামলা করতে পারে। শুধু রিটার্নিং অফিসার যদি এই অঙ্গীকারনামা ও নোটারির সঙ্গে জড়িত থাকতেন, তাহলে কমিশন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে তার পক্ষে মামলা করতে পারতেন।’

ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, দুদক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হলফনামায় তথ্য গোপনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পত্র দিয়েছিল। কমিশন পত্রের ও অভিযোগের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে গেজেট জারির পর সেটি বাতিল করার জন্য আরপিওতে কোনো অপশন নেই। তাই দুদকের পত্রের আলোকে অবৈধ জেনেও ইসি কিছু করতে পারেনি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিশনকে চিঠি দিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত জবাব এসেছে কি না জানি না।’

এদিকে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কালে নির্বাচন কমিশনে ছিলেন সিইসি এটিএম শামসুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। ইতোমধ্যে সাবেক সিইসি ড. শামসুল হুদা প্রয়াত। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। দায়িত্ব পালনে আমরা সবার কাছে ওপেন ছিলাম। কাজেই কোনো তথ্যে গরমিল থাকলে নিশ্চয়ই বের হয়ে আসত। আর ওই সময় হলফনামায় কোনো তথ্য গোপনের অভিযোগও আমাদের কাছে আসেনি।’

বর্তমান এএমএম নাসির উদ্দিন কমিশনও উত্তরসূরির সঙ্গে তালমিলিয়ে বলেছে, ‘গেজেট জারির পর হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলেও তাদের আইনি বাধায় কাউকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিতে পারে না। অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে, হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থী তথ্য না দিলে বা হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে রিটার্নিং অফিসার নিজ উদ্যোগ অথবা কোনো ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত তদন্ত পরিচালনা করতে পারবেন এবং কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। এ ছাড়া হলফনামায় প্রদত্ত কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হলে তা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

আর আগামীতে হলফনামার তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি নির্বাচনের সময় হলফনামা দাখিল করা হয়। কিন্তু এটি যথাযথভাবে যাচাই করা হয় না। এজন্য নির্বাচন কমিশন, এনবিআর ও দুদকের মধ্যে সমন্বয় দরকার। আমরা সংস্কার কমিশন থেকে এ বিষয়ে একটি সুপারিশও করেছি।’