Image description

একই অপরাধী। ভুক্তভোগীরাও সাধারণ মানুষ কিংবা ব্যবসায়ী। শুধু পরিবর্তন হয়েছে পৃষ্ঠপোষকের। চাঁদার ভাগগুলোও যায় সেই আগের ঠিকানাগুলোতে। ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার ধরেই। থেমে নেই রাজধানী ঢাকার ক্রাইমজোনগুলোর  অপরাধ। ছিনতাই, মাদক ব্যবসা ও খুন-চাঁদাবাজির ঘটনাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বিশেষ করে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ছাপিয়ে গেছে অতীতের সবকিছু। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, শুধু ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই রাজধানীতে ৭,৮২৭টি অপরাধে মামলা হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮% বেশি। সবচেয়ে বেশি অপরাধ বেড়েছে সদরঘাট, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, রূপনগর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা ও মিরপুর এলাকায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃষ্ঠপোষক বা সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অনেকটা নতুন বোতলে পুরোনো মদের মতো। এ কারণে লাগাম টানতে ব্যর্থ হচ্ছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। ডিএমপির সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২১৭ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৬, ফেব্রুয়ারি ৩৮, মার্চে ৩৩, এপ্রিলে ২৯, মেতে ৩২ ও জুনে ৪৯ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে কেবল অভিযান নয়, প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থার গতি, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করা এবং তরুণদের জন্য খেলাধুলা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রসহ বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। নয়তো শহরের বড় একটা অংশ এক শ্রেণির অপরাধীর হাতে জিম্মি হয়ে যাবে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার অপরাধের অন্যতম নিয়ন্ত্রক এখনো কিলার বাদল এবং কিলার লাল লাল্লু। বাদল ওই এলাকার সবচেয়ে বড় কিশোর গ্যাং নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণও করছে ঘাট বাবুর মাধ্যমে। ঘাট বাবুর বিশ্বস্ত সহযোগীদের অন্যতম সন্ত্রাসী কিশোর গ্যাং লিডার রনি ওরফে ভাঙ্গারি রনি, লম্বু মোশারফ, গ্যারেজ সোহেল, চাপাতি কাইয়ুম। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কিলার বাদলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং পলাতক সাবেক কাউন্সিলর আসিফ। তাদের দেহরক্ষীদের অনেকে ছিলেন বাদলের বিশ্বস্ত সহযোগীরা। তবে সবচেয়ে বড় চমক হলো বাদল গ্যাংয়ের সদস্যরা এখনো বহাল তবিয়তে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী সদস্য। সম্প্রতি বসিলা গরুর হাটের নিরাপত্তায়ও তিনি ব্যবহার করেছেন বাদল গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারদের। বিষয়টি এখনো টক অব দ্য মোহাম্মদপুর।

গত ১৮ মে জাপান গার্ডেন সিটির বিপরীতে চাঁদা না পেয়ে আবু আলেম নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেছে চাপাতি কাইয়ুম নামের এক চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরবর্তীতে ২৭ মে একই এলাকার ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদের ওপর চড়াও হয় চাপাতি কাইয়ুমের সহযোগীরা। তারা দুজনই বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে কারও পরিবারই চাপাতি কাইয়ুমের নামে মামলা করার সাহস পাচ্ছে না। ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে সে ছিল আওয়ামী লীগ নেতা সলুর দেহরক্ষী। তবে বর্তমানে তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক আদাবর থানার বিএনপি নেতা লেদু হাসান। এই লেদু হাসান কবজি কাটা আনোয়ারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।

বৃহত্তর মিরপুরের কাফরুল ও ভাসানটেক এলাকার আতঙ্ক এখনো ইব্রাহীম। বিদেশে থেকে এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন চাঁদাবাজি, মাদকসহ ওই এলাকার অপরাধ জগৎ। পল্লবী এভিনিউ এলাকার ৩ নম্বর লাইনের সাকিল, সজীব, রকি, উজ্জ্বল, ১৭ নম্বর লাইনের রাকিব, পারভেজ, মিলন, আশিক, আলাামিন। ভাসানটেকের চান মামুন, নাটা আলমগীর, আবুল কাশেম, আলী আকবর, শফিকুল, রিপন। মিরপুর-১০, ১১ এবং এভিনিউ-৫ এর ফুটপাত চাঁদাবাজি থেকে সব ধরনের অপরাধ পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত এবং আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তার নিয়ন্ত্রণ করছে নজরুল ইসলাম নজু, লালন, শাহীন এবং মনার মাধ্যমে। গত শনিবার ও সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিরপুর ১১ নম্বর বড় মসজিদের সামনে চাঁদা না দেওয়ায় তাদের লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় হামলা করে কয়েকজন ব্যবসায়ীর ওপর। এ ফুটেজও রয়েছে এ প্রতিবেদকের কাছে।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপরাধী আমাদের কাছে কেবল অপরাধী। পরিচয় দিয়ে অপরাধ বিবেচনা করে না র‌্যাব।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর থেকে মতিঝিল থেকে কমলাপুর এলাকায় পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ভাগ্নে বাপ্পির কাছে। গোপীবাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুলের ভাই বাবুলের। তবে রামপুরায় ফের তৎপরতা শুরু করেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহজাদা। হিমেল বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে বাজারের চাঁদাবাজি, ডাকাতি, জমি দখলের সঙ্গে জড়িয়েছে শাহজাদা। মোল্লা সাকিবের গ্রুপের মাধ্যমে করছে ইয়াবার নিয়ন্ত্রণ। খিলগাঁও নন্দীপাড়ায় টিপু হত্যা মামলার আসামি রানা মোল্লা, কাদের এবং কালা বাবু সক্রিয় নানা অপরাধে। তাদের সহযোগিতায় বালু ভরাটসহ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় জাহাঙ্গীর। ইতোমধ্যে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী রমজান হতাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তবে অন্যতম সন্দেহভাজন হলেও মামলার আসামি হননি জাহাঙ্গীর।